লোকসভা ভোটের আগে এ বার মহা মহাধুমধাম ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দিনের ‘পরাক্রম পর্ব’ পালন চলছে দেশের ৫১টি শহরে। রেডিওয়ে ‘মন কী বাত’-এর ৪৮ প্রচারপর্বে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোদী বলেছেন, ভারত শান্তিতে বিশ্বাস করে। তাই কখনওই সে তার সততা এবং গরিমার সঙ্গে সমঝোতা করবে না।
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ) সূত্রে খবর, এই মুহূর্তে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে অন্তত ৫০টি লঞ্চ প্যাড সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে কৃষ্ণ ঘাঁটি এলাকায় শ’দেড়েক ও কাশ্মীর ঘাঁটি এলাকায় শ’দুয়েক জঙ্গি অপেক্ষা রয়েছে। ফি বছরের মতো এ বারেও সীমান্তে বরফ গললে জঙ্গি অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি, নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ২৭ জঙ্গি ঘাঁটি থেকে দক্ষিণ কাশ্মীরে ঢোকার ষড়যন্ত্র করছে প্রায় আড়াইশো প্রশিক্ষিত জঙ্গি, এমন তথ্যও রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে।
এনআইএ সূত্রে খবর, ২০১৬ সালে ভারতীয় সেনার এনকাউন্টারে হিজবুল কম্যান্ডার বুরহান গনির মৃত্যুর পর থেকেই দক্ষিণ কাশ্মীরে জঙ্গিদের অতিরিক্ত সক্রিয়তা লক্ষ্য করছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে একাধিক জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরও কমেনি তৎপরতা। উল্টে শেষ এক বছরে বেড়েছে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা। পাশাপাশি, উপত্যকায় একের পর এক পুলিশকর্মীর হত্যার ঘটনা হিংসার ষড়যন্ত্রকে আরও প্রকাশ্যে এনেছে। কাশ্মীরে হত্যালীলা চলবে বলে হুমকিও দিয়েছে হিজবুল।
সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের কথায়, চলতি বছরের মে মাসে সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন থামানোর প্রস্তাব দেয় পাকিস্তান। সেটা মেনেও নেয় ভারত। কিন্তু সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন থামাতে পাক প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরেও জঙ্গি অনুপ্রবেশ কমেনি। সীমান্তে পরিস্থিতিও বদলায়নি। এ দিকে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উদযাপনের আগেই সীমান্তে বিএসএফ জওয়ানের গলাকাটা দেহ উদ্ধারের পর পাক বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে ভারত। লোকসভা ভোটের আগে যে নরেন্দ্র মোদী সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুর নরম করবে না, তা স্পষ্টই ছিল। সেই কূটনৈতিক চিত্রনাট্য মেনেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার অধিবেশনে পাকিস্তানকে সন্ত্রাস প্রশ্নে তুলোধোনা করেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও।
সামনেই কাশ্মীরে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেস্তে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠী, এমনটাই মত ভারতীয় সেনার।
২৯ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের জমিতে থাকা জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় সেনার স্পেশাল ফোর্স। উরিতে সন্ত্রাস-হানার বদলা ও ভারতে একের পর এক নাশকতার জবাব দিতেই ভারতীয় বাহিনীর এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।নিঃশব্দে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে সাত জঙ্গি ঘাঁটিতে বিধ্বংসী আঘাত হেনেছিল ভারতীয় সেনা। তছনছ হয়ে গিয়েছিল লস্কর, হিজবুল আর জইশ-এর মোট ৭টি জঙ্গি শিবির।
কী এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক?
‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ কোনও যুদ্ধ নয়। এমনকী, কোনও ছায়া-যুদ্ধও বা যুদ্ধের মহড়াও নয়। কোনও দেশের সেনাবাহিনী এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামের হানাদারি চালায়, অতর্কিতে। কোনও প্রাক-ঘোষণা ছাড়াই। দেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক দীর্ঘ দিনের কোনও সমস্যা মেটাতে। তা সে কোনও অভ্যন্তরীণ শত্রু, সংস্থা বা সংগঠন হোক কিংবা বহিরাগত, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ সব সময়েই হঠাৎ করা হয়। আগেভাগে তার খবর ঘোষণা করা হয় না। খুব অল্প সময়ে, অত্যন্ত দ্রুত গতিতে শত্রুদের গোপন ডেরা বা সুড়ঙ্গ বা কোনও দুর্গম, দুর্ভেদ্য ঘাঁটির ওপরে চালানো হয় এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। ওই হানাদারি চালিয়ে শত্রুদের ঘাঁটিগুলিকে গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দিয়ে আসার পর সেনাবাহিনী আর সেই এলাকায় মোতায়েন থাকে না বা সেই এলাকা দখল করে বসে থাকে না।
হানাদারির উদ্দেশ্য সফল হলেই সেনাবাহিনী আবার দেশে বা তার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়ে সেনাবাহিনী শত্রুদের আটক বা গ্রেফতার করে না। তাদের একেবারে নিকেশ করে দেয়। তুমুল গোলাবর্ষণে তাদের ঘাঁটিগুলি মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এমন হানাদারিতে সবটাই সেনাবাহিনী করে দুরন্ত গতিতে।
‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে’র আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। যে দেশের সেনাবাহিনীই এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালাক, তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব সামান্য রাখতে হয়। এমনকী, যে এলাকায় গিয়ে সেনাবাহিনী হামলা চালাচ্ছে, সেই এলাকার পরিধি যাতে খুব বেশি না বেড়ে বা ছড়িয়ে যায় বা যারা ‘টার্গেট’, তাদের ছাড়া যেন অন্য কেউ সেনাবাহিনীর ওই ‘স্ট্রাইকে’ না মারা যায় বা জখম হয়, সে দিকেও সেনাবাহিনীকে কড়া্ নজর রাখতে হয়। তাই এই হামলা হয় অতর্কিতে, চোখের পলক পড়ার আগেই।
এর আরও একটা বিশেষত্ব হল, এই আক্রমণ হতে হবে নির্ভুল। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড’ এখানে খাটে না। একটাই নিশানা হবে, আর সেটাকেই নির্ভুল হতে হবে। আর একেবারে একশো ভাগ নিশ্চিত হয়েই সেই নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানতে হবে। এটাই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে’র মূল মন্ত্র।
Be the first to comment