মাসানুর রহমানঃ
শতবাধা বিপত্তিকে পার করে এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় অতল জলের তলে আর ছিনিয়ে আনতে হয় সাফল্যের মণিমুক্ত। আজ এই বিশেষদিনে আমরা জানবো সাঁতারু তাহারিনা নাসরিনের জলকন্যা হয়ে ওঠার কাহিনী।
হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ায় এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম তাহারিনার। ছোটবেলা থেকেই নিজেদের বাড়ির পুকুরেই সাঁতার কাটতো সে। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর সাঁতার শিখতে উলুবেড়িয়া পুরসভার সুইমিং পুলে ভর্তি হয়, সেখান থেকে উলুবেড়িয়ারই একটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনুশীলন শুরু করে তাহরিনা। অংশগ্রহণ করতে থাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। দিনের পর দিন যায় কোথাও যেন তার অত্যন্ত ভালোবাসার বিষয় হিসাবে তার মধ্যেই অতিযত্নে লালিত হয়ে উঠেছে তার এই সাঁতার। হঠাৎই তার জীবনে চলে আসে এক নতুন মোড়, ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার করার এক প্রবল হাতছানি। পিছপা হয়নি তাহরিনা, এক অদম্য জেদকে সামনে রেখে বাবা,মা,পরিবারের ভরসা- সমর্থন আর অত্যন্ত প্রিয় প্রশিক্ষক বিখ্যাত সাঁতারু মাসুদুর রহমানের অনুশীলন সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐ দূরের নীল জলে। তবে সবটা এত সহজ ছিলনা, অত্যন্ত কঠিন ছিল সে পথ চলা।
২০০৯ সালে বিখ্যাত সাঁতারু মাসুদুর রহমান বৈদ্যের সঙ্গে আলাপ তাহারিনার। কিন্ত তার জীবনের মোড় ঘোরে ২০১৩ সালে। সে বছরই বেলেঘাটা সুভাষ সরোবরে মাসুদুর রহমানের কাছে সাঁতারের অনুশীলন শুরু করে সে। ২০১২ সালে ইনকাম ট্যাক্সের চাকরি পেয়ে গিয়েছিল তাহারিনা। তাহারিনা বলে, ২০০৯ সালেই স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন তুই ইংলিশ চ্যানেল পার করতে পারবি? উত্তরে আমি বলেছিল হ্যাঁ পারব। ২০১৩ সালে সেই লক্ষ্যেই শুরু হয় কঠিন অনুশীলন। ২০১৩ থেকে শুরু করে ২০১৫-র এপ্রিল পর্যন্ত সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিস করে তারপর বেলেঘাটায় সাঁতার শিখতে যেত সে। তবে তার সব আশায় মৃতপ্রায় হয়ে যায় ২৬ এপ্রিল ২০১৫ যেদিন মারা যান মাসুদুর রহমান। ইংলিশ চ্যানেল পার করার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল তাহরিনা। মেয়ের পাশে সাহস জোগান একমাত্র তার বাবা-মা-পরিবার।
বাবা শেখ আফসার আহমেদ মেয়েকে বোঝান, ইংলিশ চ্যানেল সফল ভাবে পেরোতে পারলে তার শিক্ষক মাসুদুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। তাহারিনা আবারও স্বপ্ন দেখে কিন্তু আবারও বাধা পায় সে, কলকাতার ব্রিটিশ হাই কমিশন তার ভিসার আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে। তবে শেষমেশ কয়েকজন হিতৈষী আর কিছু সিনিয়র অলিম্পিয়ানের সাহায্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর অনুমতি পায় সে। আবারও বিপদ, এবার খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিনগুনেরও বেশি। তবে সব বাধা শেষে হার মানে তাহারিনার কাছে, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ভোর ৩টে ২৫ মিনিটে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীল জলের দেশে আর খুঁজে আনে সাফল্যের মণিমুক্ত। এই চ্যানেল পার করে সে উঠেছিল সেদিন বিকেল ৪টে ৩ মিনিট।
রোজদিনের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাহারিনা জানায়, সেদিন জলে প্রবল ঢেউ ছিল। আমার গোটা গায়ে জেলিফিশ জড়িয়ে যাচ্ছিল। তবে কখনই আমি মনের জোর হারাইনি। সাঁতার শেষ করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তবে সেদিন যে শান্তি পেয়েছিলাম তা আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। আমি চাই প্রতিটা ক্ষেত্রে মেয়েরা এভাবেই মনের জোর,জেদ, আর অফুরন্ত সাহস রেখে আগামীর দিকে এগিয়ে চলুক;সফল হোক। প্রতিনিয়ন এখনও লড়াই করে এগিয়ে চলেছি আমি এভাবেই লড়াই করে এগিয়ে চলুক প্রতিটি নারী, শুধু মনে রাখুক সবসময় আমরা নারী____ আমরাও পারি।।
Be the first to comment