
রোজদিন ডেস্ক, কলকাতা:- ট্রলি ব্যাগে দেহ-কাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। এই আবহে এবার মুখ খুললেন ঘটনার দিনের প্রত্যক্ষদর্শী সেই ভ্যানচালক ও ট্যাক্সিচালক। যাঁদের গাড়িতে চাপিয়ে নীল রঙের সেই ট্রলি ব্যাগে সুমিতার দেহ ভরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গন্তব্যস্থলে। ট্রলি ব্যাগকে কেন্দ্র করে সেদিন যে এত বড় কাণ্ড ঘটতে চলেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি দু’জনের কেউই। পরে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানতে পেরে তাজ্জব বনে গিয়েছেন ভ্যানচালক নারায়ণ হালদার এবং ট্যাক্সিচালক শ্যামসুন্দর দাস।
সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল?
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে পেশায় ভ্যানচালক নারায়ণ হালদার বলেন, “মঙ্গলবার ভোরের দিকে মধ্যমগ্রামের গীতশ্রী ভাণ্ডার মোড়ে আমি ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই সময় একজন ব্যক্তি এসে বলল, দু’জন মহিলা নাকি আমাকে ডাকছে। সেই মতো আমি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাই দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেখানে। এরপর, তাঁদের কথা মতো ভ্যান নিয়ে যায় বীরেশপল্লির ভাড়া বাড়ির কাছে।”
তিনি আরও বলেন, “ওই দু’জন মহিলাই ঘরের ভিতর থেকে একটি নীল রঙের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আসে। দেখে ভারী মনে হওয়ায় ট্রলি ব্যাগটি ভ্যানে তুলতে সাহায্য করেছিলাম। ভিতরে কী রয়েছে না আছে, দেখে একটুও সন্দেহ হয়নি। কোনও তাড়াহুড়োও ছিল না দুই মহিলার মধ্যে। ঠাণ্ডা মাথায় তারা ট্রলি ব্যাগটি নিয়ে বেরোয় ঘরের ভিতর থেকে। ব্যাগের গায়ে কোনও রক্তও লেগে ছিল না। দু’জনকেই মধ্যমগ্রামের দোলতলায় নামিয়ে দিয়েছিলাম। ভাড়া বাবদ তারা ১৩০ টাকা দিয়েছিল আমাকে। সাধারণত প্যাসেঞ্জার ও ল্যাগেজ ভাড়া আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে ল্যাগেজ থাকায় এই ভাড়া চেয়েছিলাম। দোলতলা মোড় থেকে ওরা দু’জনে একটি ট্যাক্সিতে চেপে রওনা হয়ে যায় সেখান থেকে। যে ব্যক্তি ডেকেছিল, তাঁকে চিনি না। ওই এলাকাতেও কখনও দেখেনি। সে ডেকেই চলে যায়।”
ঘটনার দিন ভোরে দোলতলা থেকে যে সাদা ও নীল রঙের ট্যাক্সিতে চেপে মা ও মেয়ে কুমোরটুলির দিকে রওনা হয়েছিলেন, সেই ট্যাক্সিচালক শ্যামসুন্দর দাস বলেন, “মঙ্গলবার ভোর ছ’টা পাঁচ নাগাদ আমি দোলতলার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন দু’জন মহিলা এসে জানতে চাইল, কুমোরটুলির দিকে যাব কি না? তখন আমি ভাড়া বাবদ ৭০০ টাকা চেয়েছিলাম তাদের কাছে। দর কষাকষির পর ৬০০ টাকায় যেতে রাজি হয় তারা। কুমোরটুলির গঙ্গার ঘাটে ল্যাগেজ নামানোর পর আরও ১০০ টাকা চাই দুই মহিলার কাছে। সেই মতো মোট ৭০০ টাকা দিলে প্যাসেঞ্জার ও ট্রলি ব্যাগ নামিয়ে আমি চলে যাই সেখান থেকে। ট্রলি ব্যাগটি বেশ ভারীই ছিল। ওরা নামাতে পারছিল না। তাই আমি নামিয়ে দিয়েছিলাম।”
ট্রলি ব্যাগটি এত ভারী কেন জিজ্ঞাসা করতেই এক মহিলা আমাকে বলে, “ব্যাগের ভিতরে কাঁসার বাসনপত্র, জামাকাপড়, খাওয়ার দাওয়ার রয়েছে। এর বেশি কিছু বলেনি।” ওঁদের কথাবার্তায় কোনও সন্দেহ হয়েছিল? এর উত্তরে ট্যাক্সিচালক বলেন, “গাড়ি চালাচ্ছিলাম বলে এতটা খেয়াল করা হয়নি। তবে ওরা কাকে যেনো বলছিল ‘ভাত, আলু ভাজা রান্না করতে বলল! খাওয়া দাওয়া করব।’ এসব কিছু! যাওয়ার পথে একবারই এয়ারপোর্টের ক্রসিংয়ের কাছে পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়ে ছিলাম, গাড়িতে তেল ভরার জন্য। গন্তব্যে নামার পর ট্রলি ব্যাগ নিয়ে কোথায় ওরা যাবে, সেসব কিছুই আলোচনা হয়নি। তাই, বলতে পারব না।” দীর্ঘ ৩২ বছরের কর্মজীবনে এমন ঘটনা আগে কখনও তাঁর সঙ্গে ঘটেনি বলে দাবি করেছেন ট্যাক্সিচালক শ্যামসুন্দর দাস।
অন্যদিকে, মা ও মেয়ের ট্রলি ব্যাগে দেহ ভরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ইতিমধ্যে ধরা পড়েছে সিসিটিভি ফুটেজে। সেখানে ভ্যান ও ট্যাক্সিতে চাপিয়ে কী ভাবে দু’জনে ট্রলি বন্দি দেহ লোপাট করার পরিকল্পনা করেছিলেন তা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই ভ্যান ও ট্যাক্সি চালককে মধ্যমগ্রাম থানায় ডেকে দফায় দফায় জেরা করা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। পুলিশি জেরায় সমস্ত ঘটনাটি তদন্তকারীদের সামনে তুলে ধরেছেন দুই চালকই।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকালে কুমোরটুলির গঙ্গার ঘাটে ট্রলি ব্যাগে করে দেহ ফেলতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে যান মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা আরতি ঘোষ ও তাঁর মেয়ে ফাল্গুনী ঘোষ। পরে তাঁদের দু’জনকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। জানা যায়, দেহটি ফাল্গুনীর পিসি শাশুড়ি সুমিতা ঘোষের। তাঁকে পরিকল্পনা করে মধ্যমগ্রামের ভাড়া বাড়িতে ডেকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে বলে একপ্রকার নিশ্চিত তদন্তকারীরা। খুনের নেপথ্যে সম্পত্তির লোভ রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। কারণ মৃত সুমিতার অসম এবং কলকাতায় বেশকিছু সম্পত্তি রয়েছে। যেগুলো হাতানোর উদ্দেশ্য ছিল মা ও মেয়ের।
ইতিমধ্যে ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত ফাল্গুনী ঘোষকে নিয়ে এসে মধ্যমগ্রামের ভাড়া বাড়িতে এক দফা পুনর্নির্মাণও করেছে কলকাতার উত্তর বন্দর থানার পুলিশ। সেখান থেকে খুনে ব্যবহৃত ইটের টুকরো-সহ আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেন্সিক দলও। তবে, খুনে ব্যবহৃত বঁটিটি এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
Be the first to comment