পঞ্চচুল্লির দর্শনে (প্রথম অধ্যায়)

Spread the love

শ্রীকুমার ভট্টাচার্য,

২০১৮ সালে আমার এক পাহাড় পাগল বন্ধুবর, মানস ব্যানার্জীর তোলা কয়েকটা ছবি দেখে জায়গাটার প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ অনুভব করি। ব্যাস! ওখানকার গাইড মহেশ জং-র সাথে যোগাযোগ ও মানসের দেওয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পকেটস্থ করে বেরিয়ে পড়লাম এবছর, ২০১৯ এর ২২-মে। কোলকাতা স্টেশন থেকে সকাল ৭.৪০ ছেড়ে পরের দিন যথা সময়ে ভোর ৬.১৫ যখন ‘বেরেলি জং’ স্টেশনে ‘আকাল তখৎ এক্সপ্রেস’ নামিয়ে দিল, তখন আমাদের দলের উচ্ছাস দেখে কে? ভোর পাঁচটা থেকেই ড্রাইভার ‘রাজ’-এর বার চারেক ফোন…“সাব জলদি কিজিয়ে”। বেচারা, আামাদের সুবিধার্থেই বারবার ফোন করে গেছে সেই কাক ভোর থেকে, কারণ বৃহৎতম গণতান্ত্রিক দেশে ভোটের ফলাফল বেরোবে সেদিন।

কোনো রকমে স্টেশনের পরিস্কার ‘রিটায়রিং-রুমে’ যতটা সম্ভব নিজেদের ক্লেদ মুক্ত করে ৭.১৫ নাগাদ গাড়িতে চেপে বসলাম, প্রায় ৩৭২ কিমির এক লম্বা সফরের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য ধারচুলা। এবারে, আমাদের ৯’জনের একটা ভারী দল। চৌশট্টি বছরের চিরনবীন মতিদা, আমার কল্যাণী থেকে আসা বান্ধবী মৌসুমী, স্ত্রী দীপান্বিতা, দীপান্বিতার বন্ধু শম্পা, শম্পার বন্ধু জিটা, আমার দুই ডাক্তার বন্ধু পরিমল ও সৈকত, সৈকতের একমাত্র প্রিয় শ্যালক অমিত এবং এই শর্মা। বেশ জমজমাট একটা দল। ‘সিক্স-লেনের’ ঝকঝকে রাস্তা বরাবর প্রায় ১০০ কিমি পথ পেরিয়ে হালদুয়ানি পৌছলাম ১০টা নাগাদ। সাহেবী কেতায় যে যার মত পছন্দের ‘ব্রাঞ্চ’ গিলে আবার এগোনো। আহা! ঘন্টা খানেক পর থেকেই কি যে শান্তি সে বলার নয়… সভ্যতার মায়াবী জালের বাইরে তখন চলে গেছি, অর্থাৎ ফোনের ‘নেট-ওয়ার্কের’ ইতি, ভোট যুদ্ধে হারজিতের খবর হারিয়েছে তার গুরুত্ব। খাঁজ ভাঙা পাহাড়গুলো ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

পাহাড়ি পথে চলমান আড্ডার হাহা…হিহির মধ্যে দিয়ে বেশ এগোচ্ছিলাম… ঘটল এক বিপত্তি! গাড়ির মধ্যের সীটে আমার বাঁদিকে দুই ডাক্তার, আমি ও ‘হেল্পার’ সিভা, বসেছিলাম। পেছনের সীটে চার মহিলা আর সামনে ড্রাইভারের বাঁপাশে অমিত ও মতিদা। হঠাৎই পাহাড়ি পথের এক পরিচিত শব্দ… ‘ওয়্যাক’! নিমেষে জানলার ধারে বসা পরিপাটি ডাক্তারের ধোপদুরস্থ জামাকাপড়ে ‘মার্বেল পেন্টিং’ হয়ে গেল। একেবারে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইকের’ মত আরকি। যদিও, আমি ও সামনে বসা দুজন ‘ক‍্যানভাস’ হিসেবে ছিটেফোঁটার সামিল হলাম, কিন্তু পরিপাটি ডাক্তারের ‘শরীর-ক‍্যানভাস’ একেবারে লেবড়ে একাকার! গাড়ি থামিয়ে আধঘন্টা ধরে পরিস্কারের পালা সাঙ্গ করে আবার পথ চলা। গাড়ির ভেতরের পরিবেশ তখন বেশ মেঘলা । এক ডাক্তারবাবুর চোখে যখন অপরাধী বোধ, অন্যজনের চোখে তখন পৃথিবী ভস্ম করার অভিব্যক্তি!

যাইহোক, এইভাবে যেতে যেতেই পিথোরাগড় ঢোকার আগে রাস্তায় কয়েকটা ছবি আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেই ছোট্টবেলার স্কুল জীবনে। গ্রামের গরীব বাচ্চাগুলো এদিক সেদিক জটলা করে বুনো ‘স্ট্রবেরি’ বিক্রি করছে পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে। ইশ্, শিলংয়ের কথাগুলো যেন যুগ পার করে চোখের সামনে ভেসে এল। গাড়ির চাকা সারানো আর চা-পানের বিরতিটুকু ছাড়া কেবল ইঞ্জিনের গোঙানি শুনতে শুনতে রাত সাড়ে দশটার সময়ে অবশেষে ধারচুলা পৌছলাম।

উফ্, পাক্কা শোলো ঘন্টার যাত্রাপথ! মহেশ জং আমাদের জন্য ‘ইউথ হোস্টেলে’ ব্যবস্থা করে দাঁড়িয়েই ছিল, তাই বিশেষ অসুবিধে হয়নি। অত রাতে নির্ঝুম ধারচুলার বাজারে মহেশের অনুরোধে একটা খাওয়ার দোকান আমাদের জন্যই খুলে রেখেছিল, সেখানেই রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্ত শরীরগুলো নরম বিছানায় এলিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।‘বাথরুম’ থেকে ভেসে আসা ছপর…ছপর জলের আওয়াজে বুঝলাম যে আমাদের পরিপাটি ডাক্তারবাবুটি ‘মার্বেল পেন্টিং’-এর অসহ্য শিল্পকলা পরিস্কারে ব্যাস্ত। জানিনা কত রাতে ঘুমোতে গেল সে…।

(পরবর্তী অধ্যায় আগামীকাল অর্থাৎ শুক্রবার প্রকাশিত হবে)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*