পঞ্চচুল্লির দর্শনে (চতুর্থ অধ্যায়)

Spread the love

শ্রীকুমার ভট্টাচার্য,

২৬মে… উফ! শান্তিতে একটু ঘুমোনোর জো নেই গা…? সঙ্গে ইস্কুলের চার চারজন ইংরিজির শিক্ষিকা, জীবিকার কারণে খুব ভোরে ওঠার বদ অভ্যেসটাকে মজ্জাস্থ করে ফেলেছে। সবে গত রাতে ‘ব্যাঙ্কক’ থেকে মতিদার আনা ‘ABSOLUTE’টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে রসাস্বাদন করে নরম কম্বলের তলায় সুখে ‘ল্যাদ-যাপনে’ নিবিষ্ট ছিলাম, ক্যাঁচর-ম্যাচর করে টেনে তুলে দিল ভোর পৌনে পাঁচটায়…, সূয্যিমামার রঙের খেলা দেখার জন্য। জ্যাকেট আর টুপিটা কোনরকমে চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, কোথায় কি? তখনো আবছা অন্ধকারে পাঁচটা চুল্লিই ম্যাড়ম্যাড় করছে, হাল্কা আলোয় পায়ের কাছে বয়ে চলেছে ‘নাওলা নদী’। কি ঠান্ডারে বাবা! হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। ঐ ঠান্ডার মধ্যে আরও মিনিট পনেরো দাঁড়ানোর পর অবশেষে রং ফুটতে শুরু করল। ঠিক ৫.০৫…, গাঢ় গোলাপী আর কমলা রং মিশে একটা অপার্থিব আলো কোথা থেকে যেন চুল্লির মাথাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ল, তারপর কমলার আভা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঈশ্বর কিরণে নিজেদের রাঙিয়ে আবার স্বমহিমায় সেই শুভ্র গাম্ভীর্যে ফিরে এল… নতুন আর একটা দিনের অপেক্ষায়।

আজ সারাদিন ডান্তু গ্রামেই এক স্বর্গসুখে অবকাশ কাটানো… তাই নেই কোনো ব্যাগ গোছোনোর তাড়া। যে যার মত করে ঘুরে বেড়াও আর আড্ডা মারো। চা আর ভাঙা কয়েকটা কেকের টুকরো মুখে পুরে গ্রামের ওপরেই একটা শিব মন্দির দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে চলল বন্ধু সৈকত। নীচে, আমাদের ‘হোম-স্টে’ থেকে মন্দিরের দূরত্ব আধঘন্টার হাঁটা পথ, তবে প্রায় ৩০০’ মত ওপরে। মন্দিরের গঠনশৈলী বেশ সাধারণ হলেও পুরো ধার্মা উপত্যকার চোদ্দটা গ্রামের মানুষগুলোর অপার বিশ্বাস আর ভক্তিরসে জারিত হয়ে আসছে এই মন্দির। প্রতি বছর অগাস্ট মাসের ২০ তারিখে শিবের পুজোকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ ধরে এখানে মেলা বসে। নাচ-গান আর যৌথ উদ্যোগে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চলে তখন। আমাদের দূর্গাপুজোর মতই এই প্রত্যন্ত প্রান্তের মানুষগুলো নানান শখ আহ্লাদ আর হৈহৈ করে কাটিয়ে দেয় সপ্তাহটা। মন্দিরের পেছনে ডানদিক দিয়ে শরু রাস্তাটা দূরের ছ’টা গ্রামের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। তারপর একটা অপূর্ব হ্রদ আছে সেখানে, তার নাম ‘আচরি তাল’। কখনো সুযোগ করতে পারলে একবার ঐ পথে হাঁটার ইচ্ছেটা রইল মনে। মন্দিরের সামনের চত্বরটা থেকে পঞ্চচুল্লির চূড়োগুলো যেন আরও বেশী ঝকঝকে দেখায়।

হঠাৎ করেই একটা পুরোনো ছবি ভেসে উঠল মনে। বছর পাঁচেক আগে ‘হার-কি-দুন’ গিয়ে সেখানে ‘ফরেস্ট-বাংলো’য় ছিলাম। সেখান থেকে ‘জং-দার’ হিমবাহের বুক থেকে নেমে আসা ‘সুপিন’ নদীর সামগ্রিক ছবিটা যেন অচেনার মাঝে এক পরিচিতের ছোঁয়া। একটু নীচেই বড়জোড় ৪০০ স্কোয়ার ফুটের একটা ধাপ জমিতে দুটো গরু দিয়ে জমি মইছে একজন। আলাপ হল। মে-অক্টোবর পর্যন্ত এই গ্রামেই থাকে, তারপর ছ’মাসের জন্য নীচে নেমে যায় জলজিবি গ্রামে। সেখানে উত্তরাখন্ডের সরকার তাদের থাকার জন্য ঘর বানিয়ে দিয়েছে। আহা! কি দৃশ্যপট চোখের সামনে… নীল আকাশের নীচে বরফে মোড়া চূড়োগুলো আর সামনে তার চাষের ব্যস্ততা।

দুপুরে, মাত্র কিলোমিটার দেড়েক হেঁটে গিয়ে একটা অসম্ভব সুন্দর জায়গায় বসে এলিয়ে আড্ডা। শহরবাসীর ক্লেদাক্ত মনগুলো বিসর্জন দিয়ে এক নিলাজ সৌন্দর্যে সম্পূর্ণ অবগাহন… পাইন, সিডার আর বার্চের ছায়ায়। রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য কেবল নিরামিষ চিবিয়ে চিবিয়ে আমাদের ‘ক্যানাইন’ দাঁতগুলোর প্রতি যথেষ্ট অবিচার চলছিল তাই, রাতে, মাস ছ’য়েকের পুরোনো ভেঁড়ার মাংস, অর্থাৎ খাঁটি ‘মটন’ রান্না করা হয়েছিল আমাদের জন্য। সেটা খাওয়ার পর দুটো ছোট প্রশ্ন আশ্চর্য ভাবেই মনে গেঁথে গেল। এক, ভেঁড়ার হাড় কি মাছের কাঁটার মত সরু হয়? আর দুই, মটনের বদলে ‘রাটন’ও যদি খেয়ে থাকি তাহলে খাদ্য তালিকায় নতুন সংযোজন ঘটল…এই আরকি।

(পঞ্চম অধ্যায় পড়তে সোমবার নজর রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*