শ্রীকুমার ভট্টাচার্য,
২৪-মে… খুব সকালে ঘুম ভাঙাতে ক্যামেরাটা নিয়ে বেরোলাম ধারচুলার রাস্তায়। কুয়াশা জড়ানো আধোঘুমন্ত একটা ছোট্ট শহর। সদ্য খোলা একটা চায়ের ঝুপড়িতে কাঠের ধোঁয়ার গন্ধমাখা এক ভাঁড় চা খেয়েই নদীর পারে হেঁটে গেলাম। যুগযুগান্ত পেরিয়ে বয়ে চলা কালীগঙ্গা বরাবর মানস সরোবরের যাত্রাপথের শুরু এই ধারচুলা থেকেই। নদীর ওপারে নেপাল। সভ্যতার আদিকাল থেকে ধারচুলার জনপদ নেপাল, টিবেটের আর ভারতের মধ্যে ব্যবসায়িক মেলবন্ধন করে আসছে।
কুমায়ুনের প্রত্যন্ত তিনটে উপত্যকা, ধার্মা, যোহার আর ব্যায়াসের যাবতীয় নিত্য প্রয়োজোনীয় মালপত্র এই ধারচুলা থেকেই সরবরাহ হয়। লোহার ঝুলন্ত ব্রীজের এপারে ‘ইন্ডো টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশের ক্যাম্প’। ওপারে ‘নেপাল পুলিশ’। দুই দেশের জনগনের অবাধ যাতায়াতের জন্য সকাল ৭.০০ থেকে বিকেল ৭.০০ পর্যন্ত ব্রীজ খোলা থাকে। ব্রীজের মুখে পৌছে দেখি তখনো আধঘন্টা বাকি ব্রীজ খুলতে। আলাপ করলাম চারজন পাহারাদারের সাথে, তাঁদের মধ্যে তিনজনই মহিলা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা ‘আই.টি.বি.পি’-তে যোগ দিয়েছেন, আপাতত এখানেই পোস্টিং। আমি পর্যটক শুনে তাঁদের সাথে চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। কড়া চায়ে চুমুকের সাথে সাথে টুকিটাকি গল্পের মাঝে গেটটাও খুলে গেল… আমিও টুক করে ব্রীজ পেরিয়ে নেপালের ধারচুলায় পা রেখে এলাম। ৯.00 এর মধ্যেই গোছগাছ ও খাওয়া সেরে আবার গাড়িতে বসা।
এবার পাড়ি দেবো ৫৯ কিমি পথ, আমাদের গন্তব্যের শেষ গ্রাম ‘ডান্তু’। ডানদিকে কালীগঙ্গাকে রেখে ঝকঝকে আকাশ আর হাল্কা ঠান্ডা গায়ে জড়িয়ে ১৩ কিমি. দূরে ‘তাওয়া-ঘাটের’ একটু আগে ‘এলাগার’ নামের এক অপূর্ব ঝর্ণাকে বাঁপাশে রেখে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পৌছে গেলাম ‘তাওয়া-ঘাট’। এক অদ্ভুত অনুভূতি মননে। ‘তাওয়া-ঘাটের’ ব্রীজ পেরিয়ে ডানদিকে বয়ে চলা কালীগঙ্গা বরাবর পাহাড়ি রাস্তাটা চলে গেছে কৈলাস-মানস সরোবরের উদ্দেশ্যে। আমরা এগিয়ে যাবো বাঁদিকের রাস্তা ধরে ধর্মা উপত্যকার দিকে, এবার থেকে ডানদিকে সঙ্গী হবে ধৌলিগঙ্গা। উফ্! শুরু হয়ে গেল ছবিতোলার কসরত! সাথী মহিলাদের দেখে কোন বান্দা বলবে যে এরা ট্রেকিংয়ে বেরিয়েছে…, ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে নানান কায়দায় ছবি তোলার হিড়িক… যেন ‘তাওয়া-ঘাট’-এ ফ্যাসান প্যারেড! যাই হোক, মানসিক স্ফুর্তি নিয়েই গাড়ি ভর্তি করে আবার এগোনো। সব ঠিকঠাক চললে ২-২.৩০ মধ্যে ‘ডান্তু’ গ্রামে পৌছোনোর কথা, কিন্তু বিধি বাম। দুপুর ১২.৩০ নাগাদ ‘উর্থিন’ গ্রামে দুপুরের খাওয়ার খেতে খেতেই বাইরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল।
হঠাৎ দেখি আমাদের যাবতীয় মালপত্র ২x২ ‘বোলেরো’ গাড়িটা থেকে নামিয়ে অন্য একটা ৪x৪ ‘বোলেরো’ গাড়িতে তোলা হচ্ছে। মহেশের কাছে জানলাম যে, সামনের রাস্তায় পাহাড় থেকে নেমে আসা বেশ কয়েকটা হিমবাহ রাস্তার বারোটা বাজিয়ে রেখেছে, তাই ৪x৪ করে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে। এই গাড়িটা মাল বওয়ার গাড়ি। ব্যাপক অভিজ্ঞতা! সামনে সৈকত ও অমিত, মধ্যের সীটে মহিলারা পেছনে তের্পল মোড়ানো খুপরিতে আমি, পরিমল ও মতিদা। খুপরিতে গুঁতিয়ে বসার পর ঠিক বুঝে উঠতে পারলামনা যে আমাদের সঙ্গে মাল উঠেছে না আমরা মালের সাথে উঠেছি। কার্ড-বোর্ডের বাক্সে গণ্ডা খানেক মুরগীর কোঁকোর-কোঁ থেকে শুরু করে ডিম, তরকারী, ঠান্ডা পানীয়ের ‘ক্রেট’ এমন কি গোটা চারেক ফোল্ডিং চেয়ারের সাথে একটা ছোটখাট ‘ডিজে’ বাক্স… এবং অবশ্যই আমরা তিনমূর্তি! বদ্ধ ক্যারিয়ারে মুরগীর কলতান আর ঝাঁকুনির নানান পাঠের প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জনের গভীরে নিজের পিতৃদেবের নামটাই যা ভুলিনি।
খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎই এক গভীর নিস্তব্ধতা। ড্রাইভার সাহেব আমাদের কানে সের খানেক মধু ঢেলে জানিয়ে দিল যে ৩”-৪” কাদা লেপা পাথর আর বরফের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না, ইঞ্জিন বন্ধ। আহা! কি বানি শোনালো গ্যা! ঘড়িতে ৩.৩০ বেজে গেছে, ডান্টু পৌছতে তখনো ১৪ কিমি বাকি! অগত্যা পোঁটলা-পুঁটলির দায়িত্ব মহেশের ওপর ছেড়ে দিয়ে বর্ষাতি জড়িয়ে হাঁটা শুরু হল। বেচারা মৌসুমীর পুরোনো চোট লাগা পা নিয়েই হাঁটতে বাধ্য হল। একটা ঝর্ণার কাছে এসে সত্যিই চিন্তান্বিত হয়ে পড়লাম। ওপরে বৃষ্টি হওয়ায় জল বেড়ে গেছে। ঐ খরস্রোত হেঁটে পেরোনোটা বেশ মুশকিল। হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে কাজ চালানোর মত একটা নড়বড়ে ছোট্ট কাঠের ব্রীজ এবং পাশের পাথরগুলোর ওপর দিয়ে কোনরকমে পথটা পেরিয়ে’ত এলাম, কিন্তু মৌসুমীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এইখানেই মহেশের মত অগণিত পাহাড়ি ‘গাইড’রা সাক্ষাৎ দেবদূতের ভূমিকা পালন করে। মৌসুমীকে বস্তার মত পিঠে চাপিয়ে ছোট অংশটা পার করে দিল। তাকে পিঠ থেকে নামিয়ে মিহি গলায় শুধু একবার বলেছিল, “দেখনেমে ইতনা ওজান নেহি লাগতি।”
শ’দুয়েক গজ সামান্য চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতেই একটা ছোট গ্রাম। নাগলিঙ্গ। গোটা পনেরো পাথরের ঘর-সর্বস্ব গ্রামটা। একটাই দোকান। তখন ৫.৩০ বেজে গেছে আর মাত্র ঘন্টা খানেক দিনের আলো থাকবে। বৃষ্টির মধ্যে সেই দোকানে বসে গরম ম্যাগি আর চা খেতে খেতে ঠিক হল যে ঐ গ্রামেই রাতটা কাটানো হবে, পরদিন সকালে ডান্টুর উদ্দ্যেশ্যে আবার বেরিয়ে পড়ব। চা খেয়ে বৃষ্টিটা একটু কমতেই দুটো পাশাপাশি বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ততক্ষণে মেঘ আর ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়তে শুরু করেছে… ঘরের মধ্যে আগুন জ্বেলে, ভ্যাঁড়ার চামরা আর কম্বলের ওপর বসার জন্য তোফা ব্যবস্থা করে দিল বাড়ির মানুষগুলো। আহা! আগুন ঘিরে সেই সন্ধের আড্ডাটা… বহু দিন মনে রয়ে যাবে ।
রাত ঘন হলো নাগলিঙ্গ ঘিরে। ঐ আগুন পোয়ানোর জাগতিক আরামের মধ্যেই আমাদের রাতের খাবার দিয়ে গেল। গরম রুটি, শবজি আর স্যালাড। এ বাড়িতে আমি, পরিমল আর অমিত নরম বিছানায় ক্লান্ত শরীরগুলো নিয়ে দুটো জব্বর কম্বলের নীচে এলিয়ে গেলাম। ওবাড়িতে বাকিদের জন্য উষ্ণতা জড়ানো কম্বলের হাতছানি।
(তৃতীয় অধ্যায় পড়তে শনিবার চোখ রাখুন রোজদিনের পর্দায়)
Be the first to comment