পবিত্র চক্রবর্তী –
১
ফকা , ভেদো , নেবু এসব নামের অর্থ খুঁজে না পেলেও এই ত্রিমুর্তিকে আদারে-বাদারে , আম-জাম-নোনা গাছের ডালে প্রায়শই ঝুলতে দেখা যায় । মুখের আদল মায় লিকপিকে শরীরের কাঠামো দেখে সকলের মুখেই এক কথা , পূব জন্মে নিশ্চয়ই এক মায়ের পেটে ছিল । আমি যে স্কুলে শিক্ষকতা করি ভাগ্যক্রমে ওরাও ওখানেই পড়ে ।
সেবার গ্রীষ্মের গা জ্বালানো দুপুরের শেষে সন্ধ্যা নেমেছে । পাড়ার মোড়ে বুড়ো বটের তলে গ্রামের মাতব্বরদের মধ্যে জোরালো কথা উঠেছে । কে বা কারা গ্রামের হাজার বছরের পুরনো ভাঙা শিব মন্দির থেকে চুরি করে নিয়েছে সোনার ত্রিনেত্র । মন্দিরের পুরুত দিনকয়েক আগে রাতের পুজো শেষ করে বেরোনোর মুখেই বীভৎস একটা মুখ দেখে আঁ আঁ করেই অজ্ঞান । পুলিশ দিন দুয়েক হম্বিতম্বি করেও লাভ হয় নি । শেষে প্রাচীন মন্দিরে যেটুকু যাতায়াত ছিল তাও হল বন্ধ । এখন সন্ধ্যে হলেই পঞ্চা পুরুতের মুখে সেই ভয়ানক মুখের কথা তারিয়ে তারিয়ে শোনে আর রাম নাম জপতে জপতে বাড়ি ফেরে ।
হাজারটা ভালোর মধ্যে একটা খারাপ থাকলে সন্দেহ আমাদের তার উপরেই পড়ে । হলও তাই । বুড়ো ষষ্ঠী খুঁড়ো একতরফা জানিয়ে দিলেন , এসবের মূলে নিশ্চয়ই ফকা , ভেদো আর নেবু । কথা হল ওদের এবার থেকে আরও বেশী করে চোখেচোখে রাখা হবে ।
২
সব জেনেও ত্রিমূর্তি নির্বিকার । ওদের যা কাজ তা তো করছেই , কিছুদিন ধরে সন্ধ্যে হলেও ঘরে পা মাড়াতে যে দেরী করছে তা ওদের বাড়ীর চিল চীৎকারেই বোঝা যায় । কয়েকদিন স্কুলে কামাই করার পর আজ তিন জনের আগমন । কেন জানি না ওদের দেখেই মাথাটা ধাঁ করে গরম হয়ে গেল । ভাবলাম বেশ করে রিপোর্ট লিখে দেব অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে । কিন্তু হা হতস্মিন । ব্যাগে বইখাতা তো দূর অস্ত , রয়েছে একগাদা বিটকেল মার্কা হাতে তৈরি কাগজের মুখোশ , এক কৌটো ভুসো কালি । কিছু বলার আগেই ফকা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “ স্যার আর যাই করুন ওগুলো নেবেন না , কাজ প্রায় হয়ে এসেছে ।” বিস্ময়য়ের ঘোর যখন কাটল , তখন শেষ পিরিয়ডের ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে । ক্লাস ফাঁকা ।
৩
পঞ্চায়েত থেকে আমার দুষ্ট ছাত্রদের সপ্তাহ দুয়েক পরে মহা সমারোহে ছোট্ট এক প্যাকেট মিষ্টি আর কৃতিত্বের স্মারক তুলে দেওয়া হল । ষষ্ঠী খুঁড়োর পাকা গোঁফের তলায় ফোকলা মুখে হাসি ধরে না । ভাবলাম ফকা-ভেদো-নেবু মাইকে কিছু বলবে । কিন্তু তারা যথারীতি মিষ্টির প্যাকেট ফাঁকা করে মা’দের হাতে কোনমতে স্মারক ধরিয়ে গাছে গাছে ঝুলতে বেরিয়ে যায় ।
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় বুড়ো বটের তলা ত্রিমূর্তির প্রশংসায় মুখোর । জানলাম , গ্রামের অদূরে বহুকালের জীর্ণ মন্দির নানা বাধার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কার হীন হয়ে আছে । অনেকে বলে হাজার বছর আগে এক রাজা এই মন্দির নির্মান করেন আর কোন এক বৃষ্টির রাতে মন্দিরেই বজ্রাঘাতে মারা যান । তিন বন্ধু প্রতিদিনকার মত মন্দির লাগোয়া জঙ্গলে ঘুড়তে গিয়ে দেখে কিছু লোক মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করছে । সন্দেহ তখন থেকেই শুরু । সন্ধ্যে হলেই ওখানে ঘাপটি দিয়ে থাকতো । তৃতীয় দিন লক্ষ্য করে মন্দিরের শিব লিঙ্গ ধরে টানাটানি করছে লোকগুলো । বেগতিক দেখে নেবু আর ভেদোকে পাহারায় বসিয়ে ফকা দৌড় লাগায় ভবানন্দ দারোগার কাছে । পুলিশের ফাঁদেও যথারীতি ধরা পড়ে বমাল সমেত চোরা কারবারির দল । বেরিয়ে পড়ে বেশ কিছু নকশা । জেরায় জানতে পারা যায় নকশায় উল্লেখ আছে প্রাচীন এই শিবলিঙ্গের নীচেই রয়েছে সুপ্রাচীন সোনার শিব মূর্তি । উপরের শিবলিঙ্গটি পুরনো হলেও ওটা আসলে চাবি । যা ঘোরালে লিঙ্গের নীচে সুড়ঙ্গের রাস্তা খুলে যায় ।
মন্দিরটি বর্তমানে পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের হাতে । তারা কিন্তু কোন মূর্তি পায় নি । তা না পাক কিন্তু আমরা যাদের হাড় জ্বালানো ভাবতাম তাদের জন্যই গ্রামের মান থাকলো ।।
Be the first to comment