সোমা মুখার্জি : ২০১৭-র ২ অক্টোবর বিহার সরকারের যেন হঠাৎ ঘুম ভাঙল বাল্যবিবাহ নিয়ে। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী ঋণ প্রথা ও বাল্যবিবাহের উপর কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেন। কারণ, ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ জানিয়েছে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও বিহারের ৪১ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে ১৮ বছরের আগেই হয়ে যায়। পাটনার মতো শহরে ৩৯ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে হয়ে থাকে নাবালিকা অবস্থাতে। পাটনার খোসবাড়ি ব্লকে ৬৭ শতাংশ নাবালিকা বিয়ে হয়ে থাকে। বিহারের রাজধানীর এই রিপোর্ট দেখেই বোঝা যায় গ্রামীণ এলাকার মানুষের মেয়েদের বাল্যবিবাহের মানসিকতা।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিহারের ৩৪০টি ব্লকে আজও ৫০ শতাংশ বিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই হয়ে যায়। শিক্ষার আলো বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে এখনও পৌঁছোয়নি। যার ফলে ঋণ প্রথা, বাল্যবিবাহের মতো ঘৃণ্য পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বিহারের মেয়েরা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাড়ির মেয়েদের অবশ্য এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, কিন্তু সংখ্যাটা খুবই কম।
শুধুমাত্র বাল্যবিবাহ নয়, সঙ্গে ঋণ প্রথার মত ঘৃণ্য পরিস্থিতির শিকার হতে হয় পাত্রী পক্ষকে। এমন কিছু নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আছে যাদের নাবালিকা অবস্থাতেই পরিচারিকার কাজে যেতে হয় নিজের বিয়ের দেনার টাকা জোগাড় করার জন্য। এইসব হতভাগ্য মেয়েদের শিক্ষার আলো তো দূরের কথা সঠিক পুষ্টিকর খাবারও জোটে না। যার ফলে ঘটে না শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। বিহারের কিছু গোষ্ঠীর প্রথা অনুযায়ী বাল্যবিবাহ ও ঋণ প্রথা পরিবারের রীতি মানা হয়। যার জন্য বলি প্রদত্ত হয় পরিবারের কন্যাসন্তানরা।
কম বয়সে বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভবতী হওয়াটাও যে তাদের জীবনের আশীর্বাদ না অভিশাপ সেটুকু বোঝার মতন ক্ষমতা থাকে না তাদের। বিহারের পাটনা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সহকারী প্রফেসর ডা. সঙ্গীতা নারায়ণের মতে, গ্রাম থেকে বহু নাবালিকা গর্ভবতী মহিলারা আসেন, যাদের বয়স একেবারেই মা হবার যোগ্য নয়। কুড়ি বছরের নীচে বহু মহিলা সন্তানের জন্ম দেন ঠিকই, কিন্তু সে সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, জন্মের সময় ওজন খুবই কম থাকে। ফলে অল্পবয়সি মা ও সন্তান উভয়ই জীবন সংকটে পড়ে। তা ছাড়াও কুড়ি বছরের নীচে মেয়েদের গর্ভবতী হওয়া উচিত নয়। ভবিষ্যতে মায়ের রক্তশূন্যতা, হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, ১৯ বছরেই অনেক কন্যাসন্তান অ্যানিমিয়ায় ভোগে অপুষ্টির কারণে। তবুও তাদের বিবাহ হয় এবং গর্ভবতী হতে হয়। বিহারের ৫০ শতাংশ মহিলাদের মধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা গেছে। ভবিষ্যতে জরায়ু ক্যানসার বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার যে বিহারের মেয়েদের ভবিতব্য তা সমীক্ষায় জানা যায়।
কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের তরফ থেকে জনজাগরণ গড়ে তোলা হলেও কার্যকর কতটা হবে তাই এখন দেখার বিষয়। উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো গ্রামীণ অঞ্চলে গড়ে তুলতে হবে। অশিক্ষিত মানুষদের বাল্যবিবাহের গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষের হাতে ৪জি মোবাইল পৌঁছে গেলেও ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষার আলো এখনও জ্বলেনি, সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে সরকারকে।
Be the first to comment