তপন মল্লিক চৌধুরী
উৎপল দত্তের বর্ণময় প্রতিভা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, তাত্ত্বিক— এই চতুর্মুখ ব্রহ্মার মতো উৎপল তাঁর সৃজনে বারবার সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেছেন। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রিচার্ড শেখ্নার সম্পাদিত পত্রিকা ‘দ্য ড্রামা রিভিউ’ (টিডিআর) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনজন নাট্যপরিচালকের মধ্যে উৎপল দত্তকে অন্যতম বলে মান্যতা দিয়েছিল। যদিও রিচার্ড শেখ্নারের বিতর্কিত মার্কিন ‘লিভিং থিয়েটার’কে উৎপল ‘অপসংস্কৃতির কবরখানা’ বলে তুলোধনা করেছেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস বিচার করলে উৎপলের নাট্যসৃষ্টির ব্যাপ্তি ও ঐশ্বর্য বিস্ময়কর। উৎপল দত্ত রচিত মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ নাটক, যাত্রাপালা ও পথনাটকের সংখ্যা একশোর বেশি। এর মধ্যে নব্বইটি নাটক প্রকাশিত ও গ্রন্থিত। উৎপল দত্ত পণ্ডিত ও বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানীও বটে। বহু মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি কবি ও ছোটগল্প লেখক। তিনি মূল স্রোতের বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম অভিনেতা এবং কয়েকটা কলোত্তীর্ণ সিনেমার অমর চরিত্রস্রষ্টা। উৎপল ক্রান্তিদর্শী রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সম্মোহনী বাগ্মী।
১৯৪৭ সালে মাত্র ১৮ বছরের প্রতিভাশালী যুবক উৎপল দত্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সহপাঠীদের নিয়ে ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস’ নাট্যদল গঠন করেছিলেন। তখন তিনি বিশ্বসাহিত্যের অক্লান্ত পাঠক। ছাত্র অবস্থাতেই ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতে বিচরণ শুরু করেছিলেন। সেই বয়সেই উৎপলের অসামান্য মস্তিষ্ক ঋদ্ধ হয়েছিল কান্ট, হেগেল, ফয়েরবাখ, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন পাঠে। তাঁর সহপাঠী উত্তরকালের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল পরে লিখেছিলেন, ‘Utpal was born brilliant’। ১৯৪৭ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র উৎপল দত্তর একটি শেক্সপিয়ার প্রযোজনা দেখে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। কেন্ডালের জহুরির চোখ আসল সোনা চিনতে ভুল করেনি। কেন্ডালের শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণে উৎপল কালক্রমে একজন প্রকৃত আন্তর্জাতিকমানের পেশাদার অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে ওঠেন। উৎপল দত্ত ১৯৭২ সালে তাঁর লেখা মৌলিক ও মননশীল গবেষণাগ্রন্থ ‘শেক্সপিয়ারের সমাজচেতনা’র উৎসর্গপত্রে তাই লিখেছিলেন, ‘আমার শেক্সপিয়ার পাঠের গুরু, শেক্সপিয়ার অভিনয়ের শিক্ষক জেফ্রি কেন্ডাল।’
১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, এই পর্বে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল বিপুল সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত দর্শকদের অভিভূত করেছিল। ১৯৪৭–৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য ভারতে অস্ত গেলেও কলকাতায় তখনও পুরোমাত্রায় সাহেবিয়ানার প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। তাই কলকাতার অভিজাত ও কুলিন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় কেন্ডালের যাবতীয় নাট্যপ্রযোজনার বিস্তারিত সমালোচনা হয়েছিল। এই পর্যায়ে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যপ্রযোজনায় ‘ম্যাকবেথ’, ‘হ্যামলেট’ ও ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে উৎপলের অভিনয় ‘দ্য স্টেটসম্যান’–এর নাট্যসমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে কেন্ডালরা দেশে ফিরে গেলেন। জেফ্রি কেন্ডালকে গুরুরূপে বরণ করে তাঁর ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ থিয়েটার দলের সুশৃঙ্খল সৈনিকের জীবন বেছে নিলেও উৎপল তাঁর নিজস্ব নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানা’ বন্ধ করে দেননি। কেন্ডালরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর ১৯৪৯ সালে উৎপল দত্তর নেতৃত্বে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ বা এলটিজি–র জন্ম হয়। ১৯৫১ সালে উৎপল ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে’ যোগ দেন। কিন্তু দশ মাস উৎপ দত্তর ভাষায় ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ থাকার পর প্রবল রাজনৈতিক বিতর্কে জর্জরিত হয়ে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৫৩–৫৪ সালে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর থিয়েটার দল নিয়ে আবার ভারত সফরে এলেন। উৎপল দত্ত তাঁর গুরুর ডাকে সাড়া দিয়ে ভ্রাম্যমাণ শিল্পীদলের শরিক হন। নিজের নাট্যদল লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে ছুটি নিয়ে উৎপল কেন্ডালের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এইভাবে তাঁর নাট্য পথের যাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ পাড়ি দিতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা পরবর্তীতে হিন্দি ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা।
Be the first to comment