তপন মল্লিক চৌধুরী,
( শেষাংশ )
কিন্তু সব গুঞ্জন ছাপিয়ে উত্তম স্বমহিমায় ফিরে এলেন ১৯৭৪ ‘অমানুষ’ ছবিতে। এক টানা ৩২ সপ্তাহের রেকর্ড তৈরি করল ছবি। যে উত্তম বোম্বেতে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেই উত্তম বোম্বাই মার্কা ছবিকে সুপারহিট করলেন কয়েক বছর পরেই। পুজো প্যান্ডালের মাইক থেকে বড় কলারের জামা এবং চেক শার্টে বাঙালি ‘বেদনার বালুচরে’ ভেসে গেলেন পরম সুখে। ’৭৫ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’, সুচিত্রা-উত্তম জুটির শেষ ছবি, একই সঙ্গে সুপ্রিয়ার সঙ্গে ‘সন্ন্যাসী রাজা’, প্রথমটা ফ্লপ হলেও পরেরটা হিট। ’৭৬–এর পুজোয় উত্তমের ছবি ছিল না। ’৭৭–এর পুজোয় ‘আনন্দ আশ্রম’, পুনশ্চ শক্তি সামন্ত। টানা ২৬ সপ্তাহ ধরে হল দখল করল। ফের প্যান্ডালে প্যান্ডালে বাজতে থাকল ‘পৃথিবী বদলে’ ফেলার গান।
আজ থেকে চার দশক আগেও পুজোয় ছবি মুক্তি পেত, ব্যবসার দিকে তাকিয়ে থাকতেন প্রযোজক, পরিবেশক, হল-মালিক এমনকি হলের বাইরের ঝালমুড়িওয়ালাও। তখন তো কেবলমাত্র সিঙ্গল-স্ক্রিন, মাল্টিপ্লেক্স শব্দটা ছিল না বলেই ধারণা। তো যাই হোক বাঙ্গালি অবাঙালি সব মানুষই পুজোর সময় প্যান্ডালে প্যান্ডালে ঘুরে যেমন ঠাকুর দেখতেন, ছবিও দেখতেন। তবে তখন একটি প্রেক্ষাগৃহে একটি ছবিরই তিনটি শো হত। পুজো নিয়ে মানুষের উন্মাদনা তখনও ছিল ছবি দেখার আগ্রহও ছিল প্রচুর। পুজোয় মুক্তি পাওয়া ছবি যথেষ্ট ভাল ব্যবসা করত। এখন মল গজিয়েছে চারদিকে, টেলিভিশনের কয়েকশো চ্যানেল, সিরিয়াল, পুজোয় থিম, ঠাকুর দেখার পাশাপাশি মাল্টিপ্লেক্স হোক কিংবা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার হুজুগ কিন্ত্ত কমেনি৷ কমেনি বলেই বছরে এখন পুজোর সময় ৫টা-৬টা বাংলা সিনেমা একই দিনে মুক্তি পায়৷ ব্যবসার অঙ্কটা প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শকরা নিশ্চয় আমার আপনার চেয়ে ঢের বেশি জানেন বলেই যে ছবিটা পুজোর সময় লোকে ভাল খাবে সেটাই বাজারে ছাড়েন।
প্রসংগত; তুলনামূলক অন্যান্য পরিচালকদের চেয়ে সত্যজিতের ছবি তখন পুজোয় মুক্তি পেয়েছে বেশি৷ কিন্তু কি কারণে সেটা ঘটেছিল নাকি ঘটানো হয়েছিল জানা নেই। তবে এটা ঠিক যে পুজোয় তাঁর ছবি মুক্তি পাক এমন আবদার নিশ্চয় সত্যজিৎ করেননি৷ সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়ার নিয়ম এবং রিলিজ চেন চক্র ইত্যাদি ঘটনা চক্রের অঙ্কের ফলে তাঁর ছবি পুজোয় মুক্তি পেয়েছে৷ অন্যদিকে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ এবং ‘পদাতিক’ পুজোয় মুক্তি পেয়েছিল একমাত্র মেট্রো এবং এলিট সিনেমা হলে৷ তিনিও যে পুজোর সময় তার ছবি মুক্তি পাক এমনটা চেয়েছিলেন বলে মনে হয় না৷
বাংলা ও বাঙালির অনেক কিছুই পালটে গিয়েছে, আরও অনেক কিছুই পালটাচ্ছে। কিন্তু এখনও পালটায়নি পুজোর সময়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার রীতি। হয়ত এমন ভাবনা থেকে যে এই সময়ে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলি বছরের সেরা অথবা অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে বিষয়টি কারও পক্ষেই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে একটা বিষয় প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সমান তালেই কাজ করে যাচ্ছে, সেটা হল ব্যবসা ঘিরে আশঙ্কা। এটা তখনও ছিল আজও আছে। তখনও পুজোর সময়ে একাধিক বাংলা ছবি মুক্তি পেত এখনও পাঁচ থেকে ছ’টি ছবি একই দিনে মুক্তি পায়,অনেক আগে থেকেই স্বগুলিকে প্রচারের আলোয় আনার নানা চেষ্টা চলে। কিন্তু ব্যবসা কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তিত থাকেন প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শকরা।
অনেকেই এই প্রশ্ন করেন পুজোর সময় মুক্তি প্রাপ্ত ছবির লম্বা তালিকায় উত্তমকুমার এখনও কেন মাথায় চড়ে বসে আছেন? তাপস পাল বা প্রসেনজিত্ কিংবা দেব অথবা জিত্ কেন টলিউডকে পারেন নি তার একভাগ নিশ্চিন্তি দিতে? মনে রাখতে হবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) থেকে শুরু করে ‘দুই পৃথিবী’ (১৯৮০) হিসেবে ধরলে ২৭ বছরে ১৮৫ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার৷ কখনও কখনও বছরে ১২টি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে তাঁর৷ তার মানে গড় হিসেব মতো বছরে ৭টি ছবিতে থাকতেন উত্তমকুমার৷ তার ফলে সারা বছর ধরেই কোনও না কোনও চেন-এ তাঁর ছবি থাকতই৷ এমনকি পুজোতেও তিনি থাকতেন এক বা একাধিক ছবিতে৷ তাই ২৭ বছরে ২০টি পুজোয় তাঁর কোনও না কোনও ছবি পাওয়া গিয়েছে৷ আগে দেব বা জিত কিংবা প্রসেঞ্জিত সেটুকু করে দেখান, তারপর তো অন্য আলোচনার অবকাশ।
Be the first to comment