অনিলদাকে শ্রদ্ধা …

Spread the love

অনিল বিশ্বাসের সাথে আমার পরিচয় সাংবাদিক জীবনের শুরুর দিকে। বাংলার টেলিভিশন জুড়ে তখন একটাই নাম ‘খাস-খবর’। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দর্শকের সামনে এল ‘খবর এখন’। আমি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে এম.এ পড়ছি। ঢাকুরিয়া সাউথ এন্ড পার্কে ছিল ‘খবর এখন’ এর অফিস। পাশেই সচিন দেব বর্মণের বাড়ি। যাই হোক, ‘খবর এখন’, যাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত সেই প্রতিভাধর মানুষটির নাম অভিজিৎ দাশগুপ্ত ওরফে রাণা। অনিল বিশ্বাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিশেষ কারণ বশত এই প্রসঙ্গটি টানছি। আমাদের তখন বয়স খুব কম। আমার তো ২১ প্লাস। তখনও ‘খবর এখন’ দর্শকদের সামনে আসেনি। ট্রেনিং চলছে। অভিজিৎদা আমাদের বললেন, ‘তোমরা নতুন নতুন স্টোরি ভাব’। তিনি জানতেন অল্পবয়সী এই শিশু উদ্ভিদও দিতে পারবে সুন্দর ফুল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে রাখালদার ক্যান্টিন তখন আমাদের জীবনে একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলো। তাঁর সেই ভেজিটেবল চপ বা গজার স্বাদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিন রুমে আড্ডা, জীবনের কুলুঙ্গিতে সযত্নে রাখা আছে। আমি অভিজিৎদাকে বললাম, ‘আমি রাখালদার ক্যান্টিন নিয়ে স্টোরি করবো’। খুশি হন তিনি। এরপর রাখালদার ইন্টারভিউ নিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যাই। কথায় কথায় রাখালদা বলেন, ‘কত ঘটনার সাক্ষী আমি। অনিল, বিমান, প্রিয়, বুদ্ধ, আবৃত্তিকার পার্থ-গৌরি কে না এই ক্যান্টিনে আড্ডা মেরেছে’। রাখালদা আরো সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন। সেগুলো না হয় পরে কখনো জানানো যাবে।

অফিসে এসে এই ইন্টারভিউ-এর কথা বলার পর সিনিয়র এডিটর সত্যেন মোহান্তি বলেন, ‘তাহলে তোমাকে যাদের যাদের নাম বলেছে তাদেরও ইন্টারভিউ করতে হবে’। পার্থ ঘোষ – গৌরি ঘোষকে ফোন করে বলতেই সম্মত হলেন ইন্টারভিউ দিতে। এরপরের বিষয়টিতে খুবই কঠিন। সিপিএম তখন বাংলা রাজনীতির মধ্যগগনে। সেই সিপিআইএম দলের রাজ্য সম্পাদক হলেন অনিল বিশ্বাস। গণশক্তির এডিটরও ছিলেন। রাশভারী এই মানুষটি কখনও হাসেন না বলে শুনেছি। কিন্তু আমি চিরকালের একবগ্‌গা। কঠিন অঙ্ক করতেই বেশি ভালোবাসি। সুতরাং চেষ্টা চালালাম। ডায়াল দেখে যখন নাম্বার বের করছি সহকর্মী সোমা একটু সাবধানের সুরে আমাকে বললো, ‘এরা অত্যন্ত স্নব। তুই কাদের ইন্টারভিউ নিতে যাচ্ছিস, তা জানিস!’ জেদ আরও বেড়ে গেলো। ফোন করলাম আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে। নিজের পরিচয় দিয়ে অনিল বিশ্বাসকে চাইলাম। প্রায় ম্যাজিকের মত হলো বিষয়টা। উনি এক কথাতেই রাজি হলেন। বললেন, ‘বিকেলে এসো’। ক্যামেরা ক্রু নিয়ে বিকেলে রওনা হলাম আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে। রাখালদার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করাতে খানিকটা স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লেন সঙ্গে একথাও বললেন, ‘আমার মত দরিদ্র পরিবার থেকে যারা এসেছে তারা রাখালদার ক্যান্টিন, প্রমোদদার ক্যান্টিন অথবা কফি হাউসে যতটা যেতাম তার চেয়ে বেশি যেতাম বসন্ত কেবিনে। হাতে পয়সা যে কম’। তোমরা বসন্ত কেবিন নিয়ে স্টোরি কর, বললেন আমাকে। ইতিমধ্যে বিমান বাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়নি। দেখলাম পাশের ঘরে তিনি বসে আছেন। সাহস করে ঢুকে প্রশ্ন করলাম রাখালদাকে নিয়ে। উনিও অনেক সুন্দর স্মৃতির কথা বললেন। যাই হোক এরপর ‘খবর এখন’, তারপর ‘আকাশ বাংলা’ চ্যানেলে অনিল বিশ্বাসকে কভার করেছি বহুবার। আলিমুদ্দিনের বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে এই মিতবাক, কঠোর পরিশ্রমী এবং বড় সংগঠককে দেখে তাঁর উত্তর শুনে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড ছিলেন তিনি। মনে পড়ে একদিন সাংবাদিক সম্মেলনের পরে আমরা দুজন সাংবাদিক এসেছিলাম। আমার সঙ্গে অপর সাংবাদিক খুবই কাকুতি মিনতি করেন বিষয়টি আরেকবার বলে দেওয়ার জন্য। অনিল বিশ্বাসের একটাই কথা, ‘না, তোমরা ঠিক সময়ে আসো নি।সুতরাং আর বলা যাবে না’।

অনিল বিশ্বাস কোনোদিন কোনো মন্ত্রী হননি। মুখ্যমন্ত্রী তো দূর অস্ত। কিন্তু সিপিআইএম দলটাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মত। সিপিএম-এর মুখপত্র গণশক্তি তাঁর সম্পাদনাতেই সর্বোচ্চ পাঠক সংখ্যা পায়। এছাড়াও তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদক ছাড়া পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ নদিয়ার করিমপুরে জন্ম হয় তাঁর। ছাত্র-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পড়াশোনা করেছেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজে। পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স ছিলো। এক সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও তাঁর সময়ে অনিলবাবু ছিলেন পার্টির সর্বোচ্চ নিয়ামক। তাঁকে বলা হতো স্ট্রাটেজি মাস্টার। ছোটখাট বহু পত্র পত্রিকার তিনি সম্পাদনা করতেন। পার্টি অফিসের অদূরেই থাকতেন। স্ত্রী গীতা একটি অফিসে করণিকের চাকরি করতেন এবং অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন। একমাত্র মেয়ে অজন্তা ছিলো অনিলবাবুর প্রাণ। বলা যায় যে পার্টি যদি তাঁর এক হাত হয় তবে অন্য হাতটি অজন্তা। অত্যন্ত গুণী ছিল অজন্তা। যেমন পড়াশোনায় তেমনি ভদ্র এবং শান্ত।

২০০৬ সালে পার্টি অফিসেই বৈঠক শেষ করে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটা ছিল ১৮ই মার্চ। ডাক্তারেরা বলেন তাঁর ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছে। এই অবস্থাতেও আমরা সাংবাদিকরা প্রত্যেকদিন উডল্যান্ড নার্সিংহোমে বসে থাকতাম অনিলদার শরীর সম্পর্কে খবরাখবর নেওয়ার জন্য। রোজই রিপোর্ট বেরোত, বেশিরভাগ দিনই রিপোর্টে আসত, critical but stable। এইভাবে চলতে চলতে ২৬শে মার্চ প্রয়াত হলেন অনিল বিশ্বাস। তাঁর ইচ্ছামত এন আর এস হসপিটালে দেহদান করা হয়। অনেকে বলেন অনিল বিশ্বাস থাকলে বাংলার রাজনীতি অন্যপথে গড়াতো। কি হতো বা না হতো তা ভেবে কাজ নেই। বাস্তব হলো অনিল বিশ্বাস চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ এবং অজস্র শুভানুধ্যায়ী। রোজদিনের তরফে জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*