তপন মল্লিক চৌধুরী
নেদারল্যান্ডের বেরাইড শহরের অনতিদূরে একটি ছোট গ্রামের নাম গ্রুট জুন্ডার্থ। এই গ্রামের একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন উইলিয়াম ভিন্সেন্ট ভ্যান গঘ। জন্মের পর পিতামহের নামে তার নামকরন করা হয়। সেই সময়ে পূর্বপুরুষদের নামে নবজাতকের নামকরনের প্রচলন ছিল। শৈশবে তিনি শান্ত স্বভাবের ছিলেন। শৈশবে তিনি জুন্ডার্থ গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে মাত্র একজন ক্যাথলিক শিক্ষক ২০০ জন ছাত্রকে লেখাপড়া করাতেন। ভ্যান গঘ ও তার বোন আন্না গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করেন। এরপর ভ্যান গঘ বাড়ি থেকে ২০ মাইল দূরের জেভেনবার্গেনের একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি হন। পাশাপাশি কন্সটান্টজি সি হুইস্ম্যানস-এর কাছে কিছুদিন চিত্রকলা বিষয়ক শিক্ষা গ্রহন করেন।
ভ্যান গঘ খুব ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলা বিষয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন। ছোট ভাই থিও এবং তিন বোনের সঙ্গে ভ্যান গঘ খেলাধূলায় খুব কমই অংশ নিতেন। ছোট্ট বেলা থেকেই তিনি একটু অন্য ধরণের ছিলেন। গাঁয়ের নির্জন মাঠে-ঘাটে একা একা ঘুরে বেড়াতেন তিনি। তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধবও তার ছিলো না। ১২-১৩ বছর বয়সে তিনি প্রথম আঁকতে শুরু করেন। এই সময়টা মূলত পেন্সিলে ড্রইং করতেন আপন খেয়ালে। ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পাঠ শেষ করেই কাকার অফিসেই ভিনসেন্টের চাকরি হয়। টানা চার বছর চাকরি করাকালীন তিনি তিনি হেগ, লন্ডন ও প্যারিসে ভ্রমণ করেন এবং পরে তিনি ইংল্যান্ডের আইসওর্থ ও রামসগেটে পড়ান। তিনি ওই বয়সে অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং একজন যাজক হতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি বেলজিয়ামের একটি খনির অঞ্চলে একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে কাজ করেন যেখানে তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষের স্কেচ করতে শুরু করেন। ছবি আঁকার প্রথম পর্বেই তিনি তাঁর অন্যতম ছবি আলু খাদক একেছিলেন। তাঁর তখনকার কাজগুলো ছিল অন্যরকম এবং তখন কোনো গাঢ় রঙের চিহ্ন ছিল।
১৮৮৬ সালের মার্চে, তিনি প্যারিসে আসেন এবং ফরাসি ইমপ্রেশনিস্টদের আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে, তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সে যান এবং সেখানকার প্রবল সূর্যরশ্মির দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁর আঁকা ছবিগুলোতে উজ্জ্বল রঙ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি এক ছবির অনন্য এক শৈলী বিকশিত করেন যা ১৮৮৮ সালে আর্লেসে থাকার সময় তিনি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য ভিনসেন্টের শিল্পকলার গুণ যতই বেড়েছে প্যারিসের অন্য শিল্পীদের কাছে ততই তিনি সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠছিলেন। বিষন্ন, বিরক্ত ভ্যান গঘ যত মদ্য পান করতেন, তার মেজাজ আরও তিরীক্ষ হয়ে উঠত। অথচ সরল এই শিল্পী কখনোই তার মতকে আড়াল করতে পারতেন না, বা মৃদুভাবে কোনো বক্তব্য প্রকাশও করতে পারতেন না। একটুতেই উত্তেজিত হয়ে যেতেন তিনি। ১৮৯০র নভেম্বরে পল গঁগ্যা সাথে ভ্যান গঘের সাথে সাক্ষাতে আর্লেসে আসেন। তারপর তাঁরা দুজন একত্রে ছবি আঁকেন। গঁগ্যা সূর্যমুখীর চিত্রকর: ভ্যান গঘের প্রতিকৃতি শিরোনামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ভ্যান গঘ অন্যদিকে তাঁর লাল আঙুরক্ষেত ছবিটি আঁকেন।
ভ্যান গঘ একজন অন্যতম পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী। রুক্ষ সৌন্দর্যের এবং আবেগময় সততার প্রকাশ, সপ্রতিভ রং-এর ব্যবহারের কারণে তাঁর কাজ বিখ্যাত ছিল যা বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলায় সুদূরপ্রসারি প্রভাব রেখেছিল। মধ্য বিশের পরে তিনি চিত্রকর্ম আঁকা শুরু করে অসংখ্য বিখ্যাত চিত্রকর্ম তাঁর জীবনের শেষ দুই বছরে আঁকা। প্রতিকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, সূর্যমুখী ফুল, গমের ক্ষেত ইত্যাদি তাঁর বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল। মাত্র এক দশকে তিনি ২,১০০-এর বেশি চিত্রকর্ম আঁকেন, যার মাঝে ৮৬০টি তৈলচিত্র এবং ১,৩০০-এর বেশি জল রং-এর। দীর্ঘ বিষন্নতা ও মানসিক অসুস্থতার কারণে তিনি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।
Be the first to comment