রোজদিন ডেস্ক :- বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং সবচেয়ে দীর্ঘ চাকরির ইন্টারভিউ পর্ব এবার শেষ হতে চলেছে ! আগামী ৫ নভেম্বর, আমেরিকার নাগরিকরা একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার জন্য ভোট দেবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনে কমলা হ্যারিস জয়ী হলে তিনিই হবেন প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যিনি স্বাধীন বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে নির্বাচিত হবেন। যদি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জয়ী হন, তবে ১৮৯২ সালের পর এটি প্রথমবার কেউ প্রায় পরপর প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হবেন। এর আগে যিনি এই অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তিনি হলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড, যিনি ১৮৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ৷ ১৮৮৮ সালে হেরে গিয়েছিলেন এবং ১৮৯২ সালে ফের জয়ী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে ফিরে আসেন।
আমেরিকার এই নির্বাচন বিশ্বের অন্যান্য দেশের নির্বাচনের থেকে আলাদা। ভারত, ব্রিটেন বা কানাডার মতো দেশে ভোটারদের ভোটে রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হন৷ এখানে ভোটাররা সংসদে বিজয়ী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা শীর্ষনেতা প্রধানমন্ত্রী হন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সারা দেশের মোট ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন না। আমেরিকায় তথাকথিত জনপ্রিয় নির্বাচন একটি অর্থহীন পরিসংখ্যান মাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি স্টেটে একজন প্রার্থীর ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে জয়ী হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কোনও একজন নির্ধারিত প্রার্থী নন বা আমেরিকার সাধারণ ভোটারের পছন্দের প্রার্থী নন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে জয়ী হওয়া প্রার্থীরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে তাঁদের ভোটের মাধ্যমে শীর্ষ রাষ্ট্রনেতা বেছে নেন৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাজিক নম্বর হল ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট। বিশেষ করে, মার্কিন মুলুকের সাতটি তথাকথিত ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ স্টেটে প্রতিটি প্রার্থী কেমন ফলাফল করেন, সেটাই দেখার ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সাতটি স্টেট হল, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন, মিশিগান, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা এবং উত্তর ক্যারোলিনা। রিয়েলক্লিয়ার পলিটিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২ নভেম্বর পর্যন্ত ভোটের গড়ে এগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনের দিনে ট্রাম্প এই লিড ধরে রাখতে পারলে তিনিই হবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট।
রাজনৈতিক ভোটিং একটি শিল্পের মতোই বিজ্ঞান। স্বাধীন, পেশাদার সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত উচ্চ-মানের ভোটের গড় হিসেব করে একটি একক সমীক্ষার উপর নির্ভর করে মূল গণনার ত্রুটি কমাতে সাহায্য করবে। আরসিপি গড় এই ক্ষেত্রে সোনার মতোই মূল্যবান ৷ একের পর এক সমীক্ষার ফলাফল দেখে বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন নাগরিকদের কাছে চারটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: অর্থনীতি (মুদ্রাস্ফীতি, চাকরি, বেতন); অবৈধ অভিবাসন (ট্রাম্প অফিস ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে প্রায় ২ কোটি অভিবাসী সীমান্ত অতিক্রম পেরিয়েছে); মহিলাদের অধিকার (গর্ভপাত সহ অন্যান্য অধিকার); এবং বিদেশে যুদ্ধ এবং বিশ্বে আমেরিকার অবস্থান।
হ্যারিসের চ্যালেঞ্জ ছিল প্রেসিডেন্ট বিডেনের বিপর্যয়মূলক নীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। সর্বশেষ চাকরির প্রতিবেদন মিলিয়ে দেখা গিয়েছে যে, প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম চাকরি তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত যুদ্ধ ও হিংসার ঘটনায় আমেরিকার ২০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা সত্ত্বেও ইউক্রেন হারছে। ফলে, মার্কিন নাগরিকরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাইডেন-হ্যারিসের নীতির প্রজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। প্রায় ৭৪ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন যে, আমেরিকা ভুল পথে চলেছে। ঐতিহাসিকভাবে, যখন ভুলের সংখ্যা এত বেশি হয়, তখন ক্ষমতাসীন প্রার্থীকেও, (এই ক্ষেত্রে হ্যারিস) পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
প্রত্যক্ষ ভোটের ময়দানে বিজয়ী প্রার্থীর কৌশলগত পদক্ষেপই এই ফলাফল নির্ধারণ করবে। অনেক মহিলাই হ্যারিসকে নিয়ে আশাবাদী৷ কারণ, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি ভোট দিয়েছেন৷ তাই, হ্যারিসও তাঁর জয়ের জন্য মহিলাদের উপরই নির্ভর করছেন। কমলা হ্যারিস যদি এই ভোট যুদ্ধে মার্কিন স্টেটগুলিতে তাঁর ‘টার্গেট ভোটার’দের উত্তেজিত করতে পারেন, তবে তিনি জিতে যেতে পারেন। আমেরিকার মহিলারা অর্থনীতি, চাকরি এবং সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাদের ক্ষমতায়নের বিষয়েও যত্নশীল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনে আরেকটি জটিলতা হল যে, আমেরিকায় তিনটি উপায়ে ভোট হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত ভোটদান, যা কিছু স্টেটে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল ৷ এরপর ৫ নভেম্বর ব্যক্তিগত ভোটদান এবং ডাকযোগে ভোট দেওয়া। খুব বড় এলাকা এবং কম জনঘনত্ব-সহ কিছু স্টেটে, যেমন আলাস্কায় ভোটদান শুধুমাত্র ডাকযোগে করা হয়।
মার্কিন মুলুকের সাতটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেটে নির্বাচনী ফলাফলের মধ্যে ব্যবধান এত কম হতে পারে যে সমস্ত মেল-ইন ব্যালট গণনা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী রাতে বিজয়ী প্রার্থীকে ডাকা হবে না। প্রকৃতপক্ষে, ২০২০ সালে ট্রাম্প নির্বাচনের রাতে পেনসিলভেনিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৷ কিন্তু, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস হাজার হাজার মেল-ইন ব্যালটের গণনা হয়ে গেলে চার দিন পর বাইডেনের নাম ডেকেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষের প্রার্থীর বিষয়টিও রয়েছে। মিশিগানের কথা বিবেচনা করা জরুরি ! মার্কিন ভোট-যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্টেটের জনসংখ্যা প্রচুর মুসলিম আমেরিকান রয়েছেন। আমেরিকার অনেক মুসলিম মনে করেন যে, ইজরায়েলের ক্ষেত্রে বাইডেন-হ্যারিসের নীতি, যা ৪০,০০০ প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করতে সাহায্য করেছে, তা অত্যন্ত নির্মম ছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির এই ভোটাররা তাদের ভোট তৃতীয় পক্ষের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জিল স্টেইনের জন্য দিতে ইচ্ছুক। এই নির্বাচনে, ভোটারদের এই ধরনের পদক্ষেপ ট্রাম্পের নিশ্চিত ভোটকেও ঘুরিয়ে দিতে পারে।
আরব ইজরায়েলি রাজনীতি পেনসিলভানিয়াতেও চলছে। অনেকেই ভেবেছিলেন, কমলা হ্যারিস সেই রাজ্যের জনপ্রিয় গভর্নর জোশ শাপিরোকে তার নির্বাচনী সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন। কিন্তু, সারা দেশের আরব আমেরিকানদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে, তিনি শাপিরোর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেন, যিনি একজন ইহুদি। ওই সিদ্ধান্ত এখন ভোটের আবহে ভিন্ন প্রভাব ফেলছে৷ শাপিরোকে যদি বেছে নেওয়া হতো, পেনসিলভানিয়াকে আগের তুলনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তুলত।
এমন একটি উত্তেচনাপূর্ণ নির্বাচনে, বিজয়ী পক্ষ উদযাপন করবে এবং পরাজিত পক্ষ প্রতিবাদ করবে, মামলা দায়ের করবে এবং এমনকি হিংসার পথও অবলম্বনও করবে। মুক্ত বিশ্বের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমনই নানা পরিস্থিতি রয়েছে।
যে-ই জিতুক বা হারুক না কেন, আমেরিকার নাগরিকরা একটি কারণে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। এই অতি-দীর্ঘ নির্বাচনী মরসুম অবশেষে শেষ হতে চলেছে। আর এই প্রচারের কোনও বিজ্ঞাপন নেই, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সঙ্গে কোনও অস্বস্তিকর আলোচনা বা বাগবিতণ্ডা নেই। সর্বপরি ভোটের সর্বশেষ ফলাফলের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর রাখতে হয় না৷ আমেরিকা অবশেষে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চলেছে।
Be the first to comment