ভাস্কর ঘোষাল
ছয় মাস আগে বিধানসভা নির্বাচনে মোদী-শাহকে পরাজিত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর সম্প্রতি উপনির্বাচনে বিজেপি-কে উড়িয়ে দিয়ে সাত কেন্দ্রেই জয়লাভ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মে মাসে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে জাতীয় স্তরে যে ভাবে দেখতে চাইছেন, তৃণমূল নেত্রীর সাম্প্রতিক গোয়া সফর তার অঙ্গ বলা যেতে পারে।
বিধানসভা নির্বাচনে জেতা দুটি আসন উপনির্বাচনে হারিয়ে বিজেপির সংখ্যা এমনিতেই কমে গিয়েছে। এ ছাড়াও বিধায়কদের দলবদলের ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে। যা বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই খাতায়-কলমের বাইরে ভাজপার ঘরে কতো সংখ্যক বিধায়ক আছেন তা গেরুয়া শিবিরের অতি বড় ভক্তেরও বলা খুবই কষ্টসাধ্য।
এই উপনির্বাচনে সামগ্রিক ফল তৃণমূলের পায়ের তলার জমি আরও শক্ত করেছে। এই জয়ের মধ্য দিয়ে রাজ্য বিধানসভার ওপর কোনও প্রভাব সৃষ্টি করবে না। কিন্তু বিজেপির ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়ার দরুন তৃণমূল মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে। আর এই উপনির্বাচনে দেশের অন্যান্য রাজ্যেও গেরুয়া বাহিনীর ফল মোটেই ভালো নয়। তাই তাৎপর্যপূর্ণ হল, আগামী দিনে অ-বঙ্গভাষী বিভিন্ন রাজ্যে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার জন্য তৃণমূল নেতৃত্বের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং ভবিষ্যতে যে আরও বাড়বে তা সন্দেহাতীত।
বাংলায় বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের একক আধিপত্যের প্রবণতা দেখা গিয়েছে। তাই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হয়ে ওঠার দৌড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ এক জন বড় দাবিদার। সেখানে কংগ্রেস অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে তার নিজের ‘জোর’ কোথায় কতটা, সেই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত।
এই রাজ্যে ভোটের আগে থেকেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিন্রাজ্যে যাওয়ার ছক কষে রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আগামী দিনে তৃণমূলের সংগঠন অন্য রাজ্যে গড়ে তোলা হবে। অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অভিষেক আপাতত উদ্দেশ্যটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এটা তাঁর কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ। পরিকল্পিত ও সংগঠিত ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তারের প্রয়াস তৃণমূলে আগে দেখা যায়নি। অভিষেক উদ্যোগী হয়েছেন। ‘সফল’ হলে সংগঠনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি হবে, সেবিষয়ে কোনও প্রশ্নই নেই।
তৃণমূল কংগ্রেস এবার নিজের রাজ্যে বিজেপিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছে। বড় ব্যবধানে জয়ের জায়গায় বিজেপিকে অল্প ব্যবধানে হারালে, ভিন্রাজ্যে যাওয়ার এই উদ্যোগ আপাতত ধামাচাপা থেকে যেত ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন, তাতে এই প্রকল্প বাস্তবে রূপায়ণ করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ।
তৃণমূল ইতিমধ্যে গোয়া, ত্রিপুরায় সংগঠন গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। কিছুদিন আগে সংগঠনের কাজ তদারকি করতে নিজে গোয়া গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যেও তৃণমূল সংগঠন গড়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এইসব রাজ্যে তৃণমূল তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতির ছাপ রাখতে পারলেও তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।
কংগ্রেস ও সমমনের অনেক দল অবশ্য মনে করে, তৃণমূলের বাংলার বাইরে নিজের সংগঠন বিস্তার করার ঘটনায় বিরোধী জোট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন যুক্তির কোনও সারবত্তা আছে বলে মনে হয় না।
কংগ্রেস বিলক্ষণ বোঝে, সামগ্রিক বিচারে ঘরে-বাইরে তারা খুব স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। অন্য দিকে মমতার জনভিত্তির উল্লেখযোগ্য অংশ মূলত কংগ্রেসি মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা। তিনি কোনও ভিন্রাজ্যে পা রাখলে তাই প্রকৃতপক্ষে ধাক্কা প্রথম লাগতে পারে কংগ্রেসের ভোট বাক্সে।
তাই শুধু বিরোধী জোটের কথা তুলে নিজেদের সেই ‘দুর্বল’ অবস্থা আড়াল করার চেষ্টা করতে চাইছে কংগ্রেস। আদপে কংগ্রেসের এই যুক্তি ধোপে টেকানো খুবই কঠিন কাজ।
গোয়ায় যেভাবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো, কিংবা উত্তরপ্রদেশে কমলাপতি ত্রিপাঠীর পরিবারের দুই উত্তরপুরুষ কংগ্রেস ছেড়ে হঠাৎ তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন তা নিয়ে ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দলের কি বক্তব্য তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। কংগ্রেসের উচিত এ নিয়ে আত্মসমীক্ষা করা।
এ কথাও মানতে হবে, জন-আকর্ষণী ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য কারও চেয়ে কম যান না। তাই গোয়া, কাশী, ত্রিপুরা বা মেঘালয়ে ভোট করতে গেলে এটা তাঁর দলের পক্ষে আপাত ভাবে একটু সুবিধাজনক। অন্য রাজ্য থেকে প্রথম যাওয়া একটি দলের পক্ষে এটা অবশ্যই রাজনৈতিক লাভের। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে যা আরও বেশি অর্থবহ।
তৃণমূলের অন্য রাজ্যে সংগঠন বৃদ্ধির ঘটনা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কংগ্রেস বা তার সমনস্ক দল। প্রকাশ্যে সরাসরি তৃণমূলের বিরোধিতা না করলেও ঠারেঠোরে বলা হচ্ছে এরফলে বিজেপি-র লাভ হবে। খুব ভালো কথা। তাহলে আমার প্রশ্ন পশ্চিমবাংলার ভোটে প্রদেশ কংগ্রেস তৃণমূলের বিরোধিতা করে বিরুদ্ধে ভোটে লড়াই করে কেন? সরল পাটিগণিতের হিসাবে বলা যেতেই পারে কংগ্রেস এখানে যে ভোট পায় তা নিশ্চয়ই বিজেপি-র নয়, তা তৃণমূলের। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, রাজ্যে ভাজপার সুবিধা করতে কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে কি লড়াই করে।
Be the first to comment