তপন মল্লিক চৌধুরী,
দিবসটি প্রজাতন্ত্র গণতন্ত্র যাই হোক না কেন, জন্মদিনটি নেতাজি গান্ধীজি যারই হোক না কেন পাড়ার কান ঝালাপালা মাইকে অন্যসব গানের ভিড়ে অন্তত একবার বেজে উঠবেই অর্ধ শত প্রাচীন সেই গানটি- অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ / জারা আঁখমে ভর লো পানি / যো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি / জারা ইয়াদ করো কুরবানি
জাতীয় সংগীত না হলেও গানটি সেই পর্যায়েই পৌঁছেছে, কোনও হিন্দি ছবির গান নয় তবু এতকাল পরেও গানটি সমান প্রচলিত। গানটিতে আবেগভরা আবেদন, হৃদয় স্পর্ষ করা সুর সর্বপরি দেশপ্রেম জাগানোর মতো যাবতীয় সম্পদ থাকার কারণে গানটি বহুলভাবেই ব্যবহৃত। কিন্তু তবু আজও গানটি বেজে উঠলেই মন ছুয়ে যায়। মনে হয় গানটির কন্ঠশিল্পী যদি সারাজীবনে আর কোনও গান নাও গাইতেন তাহলেও তিনি স্মরণীয় হতেন কেবলমাত্র এই গানটির কারনে।
কিন্তু গানটি যে সাতান্ন বছর পেরিয়েও অমর তা যে কেবলমাত্র কন্ঠের ছোঁয়া লেগে কিংবা গায়কীর জাদুবলে তা তো নয়, গানের কথায় যেমন বীর শহীদদের স্মৃতিতে প্রেম-শ্রদ্ধা-ভক্তি জাগানো ভাবনা তেমনি সুরের মূর্ছনা। সুর ও বানীর যথাযথ মেলবন্ধনেই যে গানটি প্রাণ পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কন্ঠ শিল্পীর গায়কী নৈপুণ্যের পর আর এই প্রশ্নটি আমাদের মনে উকি দেয়নি যে কে এমন কথা লিখলেন আর কেই বা সুর করলেন। সত্যি কথা বলতে নিরানব্বই জন গানের শ্রোতা গানটির গীতিকার সুরকারের কথা জানেন না।
গানটির সূতিকাগার বলা যায় মুম্বাই শহরের মাহিমা এলাকার রাস্তায়। আজ থেকে সাতান্ন বছর আগে ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে সবে মাত্র চিন-ভারত যুদ্ধ থেমেছে কিন্তু তার রেশ পুরপুরি মিলিয়ে যায় নি। যুদ্ধে শহীদদের পরিবারে তখনও প্রিয়জন হারানোর বেদনার কান্না থেমে যায় নি। এমনই এক বিষন্ন দিনে মাহিমার পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন অখ্যাত এক কবি। আরব সাগরের নোনা হাওয়া তাঁর মনকেও উদাস করে দেয়। বিষন্ন বোধ করেন কবি, দু-একটি পঙতি তাকে অস্থির করে তোলে। কিন্তু তার কাছে সেই মুহূর্তে নেই কোনও কাগজ-কলম। কিন্তু যো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি / জারা ইয়াদ করো কুরবানি পঙতি দুটি লিখে রাখা খুবই দরকার।
কবি কাছাকাছি এমন কাঊকে পেলেন না যার কাছে এক টুকরো কাগজ আর এওকটি কলম আছে। আরও সামনে এগোলেন, রাস্তার ধারে একটি পান সিগারেটের দোকান দেখতে পেয়ে সেখান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলেন। প্যাকেটের সিগারেটগুলি বের করে এক টুকরো কাগজ যাও বা হল কিন্তু দোকানদারের কাছে কলম নেই। তবে কলম পাওয়া গেল অন্য এক পান ক্রেতার কাছে। কবি ধার করা কলম দিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েই লিখে ফেললেন তাঁকে অস্থির, বিপন্ন করা ওই পঙতি দুটি। পান ক্রেতার কলম ফেরত দিয়ে জোর পায়ে হাটা দিলেন ফিরতি পথে।
ঘরে ফিরে আর সময় নষ্ট নয়। খাওয়া ঘুম ভুলে সারা রাত জেগে লিখলেন … ইয়ে শুভ দিন হ্যায় হাম সবকা / লেহেরা লো তিরঙ্গা প্যায়ারা / পর মত ভুলো সীমা পর / বীঁরো নে হ্যায় প্রান গাঁওয়ে…সারা রাত জেগে লেখা কবিতা নিয়ে পরের দিন সকালেই ছুটে গেলেন সুরকার বন্ধু সি রামচন্দ্রর বাড়ি। প্রদীপের কবিতাটি পড়েই হীরক খণ্ড চিনতে ভুল করেন না অভিজ্ঞ সুরকার। কাল বিলম্ব না করে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। কিন্তু এমন গান গাইবে কে? লতা মঙ্গেসকর ছাড়া আর কারও কথা তো ভাবা যায় না। রামচন্দ্র-র সঙ্গে লতার সম্পর্কটা তখন বেশ খারাপ, কিন্তু তাঁর কাছেই প্রস্তাব রাখলেন সুরকার। গান শুনে লতারও না বলার উপায় ছিল না। তিনি প্রবল উৎসাহে গানটি কন্ঠে তুললেন এরও পরে সেটি রেকর্ড হয়।
গানটি নিয়ে আরো অনেক কথা বাকি রয়ে গেল, সেই সঙ্গে গীতিকার প্রদীপ এবং রামচন্দ্র। সেসব কথা কয়েকদিন পরে।
শুনুন সেই গান-
Be the first to comment