ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছে

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী,

কাল সকালে যার ফাঁসি হবে সে আগের রাতে বলল, ‘আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খেয়ে বধ্যভূমিতে যেতে চাই’। তার ফাঁসির আগের মুহূর্তগুলিও আইনজীবী থেকে ফাঁসুড়ে সবাইকেই অবাক করে দিয়েছিল। ফাঁসির কথা শুনেও তার আচার ব্যবহার দেখে একবারও মনে হয়নি যে ওর মধ্যে কোনও মৃত্যু ভয় আছে।  ৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাতে সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয় ২১ মে ১৯০৮ তারিখে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত। ওই মামলার বিচারক ছিলেন মি. কর্নডফ এবং দু’জন ভারতীয়, লাথুনিপ্রসাদ ও জানকিপ্রসাদ। রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। তার বয়স খুব কম ছিল। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কি না?

সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন ক্ষুদিরামের পক্ষে সওয়ালকারী তিন আইনজীবীর একজন। এ দিক সে দিক বহু কথার পর তিনি ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কি জানো রংপুর থেকে আমরা কয়েকজন উকিল তোমাকে বাঁচাতে এসেছি? কিন্তু  তুমি তো নিজেই নিজের দোষ স্বীকার করছ’।  ক্ষুদিরামের উত্তর ছিল ‘কেন স্বীকার করব না ?’

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যার অভিযোগে যে বিচার শুরু হয়েছিল তাতে ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন উকিল কালিগাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন ও ক্ষেত্রনাথ ব্যানার্জী। পরবর্তীকালে যোগ দেন আরও কয়েকজন আইনজীবী, যাঁরা পারিশ্রমিকে মামলা চালান ও অন্যান্য খরচ বহনের জন্য চাঁদা তোলেন। ক্ষুদিরামের যত্সামান্য পৈত্রিক সম্পত্তি বন্ধক দেয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ সেই সম্পত্তি বন্ধক নিতে রাজি হয়নি। আসামি পক্ষের উকিলেরা ক্ষুদিরামের বয়স কম বিবেচনা করে লঘু শাস্তির আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক সে আবেদন অগ্রাহ্য করে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। ক্ষুদিরামের পক্ষে আইনী লড়াই করেন আইনজীবী নরেন্দ্রকুমার বসু। ১৩ জুলাই ১৯০৮ আপিলের রায় ঘোষণা করা হল— ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ বহাল। ক্ষুদিরামের প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে বড়লাটের কাছে প্রাণদণ্ড মুকুবের আবেদন করা হয়, কিন্তু অনেক বুঝিয়েও সে আবেদন গ্রাহ্য হল না। ১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য করা হয়। ওই আদেশের খবরে কলকাতার ছাত্র-যুবকেরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে প্রতিবাদ জানায়।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকের সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। ফাঁসির সময় যার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন। শেষ ইচ্ছা হিসেবে ক্ষুদিরাম তাঁর দিদি অপরূপা দেবীকে দেখতে চেয়েছিল। জামাইবাবু অমৃতলাল রায় সরকারি কর্মচারী, তাঁর ছুটি নামঞ্জুর হয়,  উপরন্তু বরখাস্তের হুমকি দেওয়া হয়। রাজরোষে পড়ার ভয়ে অমৃতলাল ক্ষুদিরামের সঙ্গে দেখা করার ঝুঁকি নেননি। দিদির সঙ্গেও শেষ দেখা হয় না ক্ষুদিরামের। কিন্তু ক্ষুদিরাম তাঁর আরেক দিদিকে শেষ দেখা দেখতে পেয়েছিলেন। ধর্মে মুসলমান সেই দিদি কোনও কিছুর পরোয়া না করে ছোটবেলা থেকে যাকে আদর-স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন, সেই আদরের ভাইটি দেশের জন্য জীবন দিতে চলেছে। শেষবারের মতো তাকে না দেখে দিদি কি থাকতে পারে? মেদিনীপুর থেকে সুদূর বিহারের মুজফ্ফরপুর? সব বাধা তুচ্ছ করে সেই দিদি মুজফ্ফরপুর কারাগারের ফাঁসির সেলে পৌঁছে যান এবং সঙ্গে নেয়া খাবার নিজের হাতে ভাইকে খাইয়ে দেন। ইতিহাস অবশ্য এই দিদির খোজ রাখেনি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*