চিরন্তন ব্যানার্জি:-
লালবাজার থেকে ৫০০ মিটার দূরে রাস্তায় বসে সোমবার থেকে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন রাজ্যের নানা সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকেরা। কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবি তুলেই তাঁরা সেই আন্দোলন শুরু করেন। মঙ্গলবার অবশেষে ২২ ঘন্টা পর স্টেথোর চাপে নতিস্বীকার করে পুলিশ। তারপরই বিকালে জুনিয়র চিকিৎসকদের ২২জন প্রতিনিধি সিপির কাছে গেলেন তাঁর পদত্যাগের দাবি নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন, প্রতীকী মেরুদণ্ড।
সোমবার রাত জাগার পর ভোরের দিকে কাউকে কাউকে রাস্তার উপরেই শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নিতে দেখা গিয়েছে। কেউ কেউ আবার কয়েক জন মিলে গোল করে বসেছিলেন বিক্ষিপ্ত ভাবে। দ্বিতীয় দিন বেলা গড়াতেই আবার এক জায়গায় জড়ো হতে শুরু করেছেন আন্দোলনকারীরা। সোমবার রাতে এক বার আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছিল পুলিশ। কিন্তু সমাধান হয়নি। মঙ্গলবার বেলা ১২টা নাগাদ ফের একবার অবস্থানরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন অ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনার সন্তোষ পাণ্ডে। চিকিৎসক কিঞ্জল নন্দ সহ বাকি প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। অ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনার অনুরোধ করেন রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য, একটি প্রতিনিধি দল যাতে সেখান থেকেই স্মারকলিপি লালবাজারে জমা দিয়ে আসে। কিন্তু চিকিৎসকরা নিজেদের দাবিতে অনড় থাকে। লালবাজারের উদ্দেশ্যে তাঁরা তিনটি বিকল্প দিয়েছেন। প্রথম বিকল্প, পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল নিজে এসে অবস্থানরত চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করবেন। সেখানে তাঁকে স্মারকলিপি পড়ে শোনানো হবে এবং তিনি সেটি গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয় বিকল্প, চিকিৎসকদের মিছিলকে লালবাজারের দিকে আরও এগতে দিতে হবে। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থল পর্যন্ত। এরপর সেখান থেকে চিকিৎসকদের একটি প্রতিনিধিদল লালবাজারে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেবেন। যদি এই দুই বিকল্পের মধ্যে কোনওটিই না হয় তবে তৃতীয় বিকল্প, পদত্যাগ করতে হবে পুলিশ কমিশনার বিনীতকে। এরপর দুপুর দুটো নাগাদ ফিয়ার্স লেনের আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে ফের এক দফা কথা বলল পুলিশ। এবার কলকাতা পুলিশের জয়েন্ট সিপি রূপেশ কুমার কথা বলতে আসেন কিঞ্জল নন্দ-সহ চিকিৎসকদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। ব্যারিকেড সরিয়ে দিলে কত দূর এগোবেন চিকিৎসকেরা, তার পর কী করবেন, সে বিষয়ে জানতে চান জয়েন্ট সিপি। আন্দোলনকারীদের দাবি, কোনও ব্যারিকেড রাখা যাবে না। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থল পর্যন্ত তাঁদের এগোতে দেওয়া হোক। তাঁরা মানববন্ধন করে ভিড় সামলাবেন। আর ২২ জনের প্রতিনিধি দল দেখা করতে যাবেন সিপির সঙ্গে। এরপর ফিয়ার্স লেনের ব্যারিকেড সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে পুলিশ। মিছিল আরও একশো মিটার এগোনোর অনুমতি দেওয়া হয় পুলিশের তরফ থেকে। ব্যারিকেডের অপর প্রান্তে যাওয়ার অনুমতি মিলতেই মনোবল আরও বাড়ে আন্দোলনকারীদের। ‘আমরা করব জয়…’, ব্যারিকেডের সামনে সমস্বরে গান গাইতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর ব্যারিকেড সরতেই লালবাজারের দিকে এগতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। তারপর লালবাজার থেকে ৪০০ মিটার দূরে মিছিল থামায় চিকিৎসকেরা, এরপর ওই পথটুকু হেঁটে যান আন্দোলনকারীদের ২২ জনের প্রতিনিধি দল। বাকিরা ৪০০ মিটার দূরেই অবস্থান করেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। প্রায় দেড় ঘন্টা পর লালবাজার থেকে বেরোন চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দল। তাঁরা বেরিয়ে জানান, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্তুষ্ট নয় তাঁরা। প্রতিনিধি দলের সদস্যেরা বলেন, “১৪ তারিখ ও ১২ তারিখের ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁরা স্বীকার করেছেন, এটি পুলিশি ব্যর্থতা। কিন্তু আলোচনার কোনও সদুত্তর আমরা পুলিশ কমিশনারের থেকে পাইনি। আমরা আমাদের দাবিতে এখনও অনড়। নৈতিক দায় নিয়ে সিপির পদত্যাগ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।” প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, তাঁরা অবস্থান-বিক্ষোভ তুলে নিলেও বিচারের দাবিতে আন্দোলন একই ভাবে চলবে।
জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল বলে, “পুলিশ কমিশনারকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি এই ঘটনায় নৈতিক দায়ভার নিচ্ছেন কি না। জবাবে সিপি জানিয়েছেন, তিনি নিজের কাজে সন্তুষ্ট। তবে যদি তাঁর কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করেন, তিনি নিজের কাজে ব্যর্থ এবং তাঁকে যদি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়— সেটিও তিনি হাসিমুখে মেনে নেবেন।” আন্দোলনকারীরা আরও জানান, যে প্রতীকী শিরদাঁড়াটি তাঁরা লালবাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটিও দিয়ে এসেছেন। লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে কথা বলার পর রাস্তার অবস্থান তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তবে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন জারি রাখবেন তাঁরা। এই সিদ্ধান্তের পর সন্ধ্যায় দেখা যায় ঝাঁটা হাতে রাস্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
Be the first to comment