শুক্রবার পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের উৎসবের সূচনায় সম্প্রীতির বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন যেন আজকের এই শুভদিনে সম্প্রীতি, শান্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা যেন দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
ওনার বক্তব্যের কিছু অংশ: এখানে উপস্থিত সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষকে জানাই বড়দিনের শুভেচ্ছা। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি কবে বড়দিন আসবে, কারণ, ছোট থেকেই আমরা এই দিনটাকে খুব পছন্দ করি ও ভালোবাসি।
উৎসবে মুখর বাংলা সারা বিশ্বকে পথ দেখায়। বাংলায় দুর্গাপুজো যেমন আমাদের জাতীয় উৎসব, কালীপুজোও বড় উৎসব, ছট পুজোও বড় উৎসব, ঈদও বড় উৎসব তেমনভাবে একই রকম সম্মানের সঙ্গে আমরা বড়দিনও পালন করি।
নতুন বছরের শুরুতে গ্রামেগঞ্জে চলে পৌষ মেলা, পীঠে পুলি উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। শহরে ওই দিনগুলিতে মানুষ উৎসব মুখর হয়ে ওঠে। এই সময়ে অনেকে সপরিবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান।
এই সময়টা আমাদের খুব প্রিয়। একদিকে শীতকাল, অন্যদিকে বিভিন্ন শস্য, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক উৎসব, পীঠে পুলি, কেক। কেক ও নবান্ন দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় পীঠে পুলি, গঙ্গাসাগর মেলায় এসে। সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার।
আমরা খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের অনুপ্রেরণায় এই উৎসব শুরু করেছি। আমরা এখানে যেরকম আলো দিয়ে সাজাই, অন্যান্য অনেক জায়গাতেই এরকম সাজানো হয়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব মানুষ পালন করে।
প্রতি বছর আমরা এই খুশির দিনে কিছু না কিছু করে থাকি। আগের বছর এই উৎসবে আমি অনেক বেকার যুবক যুবতীর হাতে গতিধারা প্রকল্পের গাড়ি তুলে দিয়েছিলাম। এবছর আমরা সঙ্গতিহীন প্রবীণ সাংবাদিকদের জন্য মাসিক পেনশন প্রকল্প আমরা চালু করলাম আজ থেকে। প্রতি মাসে তাঁরা ২০০০টাকা করে পাবেন। এছাড়া মাভৈ প্রকল্পে অন্যান্য পেশার মত আমরা সাংবাদিকদেরও বিনা পয়সায় চিকিৎসার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রায় দু’লক্ষ লোকপ্রসার শিল্পীরা মাসে ১০০০ টাকা করে ভাতা পান। প্রবীণ কৃষকদের জন্য পেনশন, বিধবাদের জন্য ভাতা, শারীরিক ভাবে অক্ষমদের জন্য প্রকল্প আছে।
আমাদের বাংলায় এখন অষ্টম শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব কন্যারাই কন্যাশ্রী। আমি চাই মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক।
এছাড়া, প্রায় ৭০ লক্ষ তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অনগ্রসর শ্রেণীর পড়ুয়া শিক্ষাশ্রী প্রকল্পে বৃত্তি পায়। ১.৭০ কোটি সংখ্যালঘু বৃত্তি পায় রাজ্য সরকারের থেকে। আমাদের সরকার লেখাপড়াকে খুব গুরুত্ব দেয়।
বাংলার ৯.৫কোটি মানুষের মধ্যে ২ টাকা কিলো চাল প্রায় ৮.৫কোটি মানুষ পায়। এবং আরও ৫০ লক্ষ মানুষ চাল পায় বাজার মূল্যের অর্ধেক দামে।
বিনা পয়সায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যায়। বিনা পয়সায় ওষুধও পাওয়া যায়, বেড ভাড়াও লাগে না হাসপাতালে। এছাড়া, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান ও ন্যায্য মূল্যের রোগ নির্ণয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে যেখানে বাজার মূল্যের থেকে ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ কম মূল্য নেওয়া হয়।
কোনও গরীব মানুষ মারা গেলে, তাঁর সৎকারের জন্য সরকার ২০০০টাকা করে দেয় সমব্যাথী প্রকল্পে। জহরথান ধর্মীয় স্থানের পাট্টা দিয়ে দিয়েছি আমরা। সংখ্যালঘুদের ২০০০ কবরস্থান করে দিয়েছি। হিন্দুদের জন্য বৈতরণী প্রকল্প করা হয়েছে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জন্যেও কিছু করার থাকলে আমাদের বলবেন, আমরা তা করে দেব।
ভারতবর্ষে বাংলা অন্যতম প্রধান রাজ্য যেখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, যেখানে আমরা ধর্মের নামে কোন ভেদাভেদ করতে দিই না। আমরা সবাই একসাথে থাকি, একসাথে সবাই সবার উৎসব পালন করি। সব ধর্মকে আমরা শ্রদ্ধা করি। উৎসব সবার, ধর্ম যার যার তার। নিজের ধর্ম নিজে পালন করুন, ভালোবাসুন, আনন্দে থাকুন। আমরা প্রত্যেকে বড়দিনে যোগদান করি। এই উৎসন সবার।
সব ধর্মরই একটা পথ – মানবিকতা। সব ধর্ম মিলিত হয় শান্তির যাত্রায়। আমাদের সবার মিলিত প্রয়াস সর্ব ধর্ম সমন্বয়। এটাকে আমরা ধরে রাখব চিরদিন, কারণ প্রত্যেক ধর্মই বিশ্বজনীন।
ক্রিসমাস সবার জন্যে শান্তির ও ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসে। ধর্ম মানুষকে দৃঢ় সংকল্প ও উৎসর্গ করতে শেখায়।
আজকের দিনে আমরা এটা জোর গলায় বলতে চাই, আমাদের দেশে গণতন্ত্র আরো সুদৃঢ় হোক। সাংবাদিকরা আরও প্রানবন্ত হোক। তারা যেন কারোর কাছে আত্মসমর্পণ না করে। সংবাদমাধ্যম যদি কারোর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। আজকে কিন্তু তাই হচ্ছে এই দেশে, তাই আমি শঙ্কিত। শুধু আমি নই, আরও অনেকে শঙ্কিত। একই সঙ্গে দেশের বিচারব্যবস্থাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচার যদি প্রলম্বিত হয়, তাহলে অবিচার করা হয়।
আজকে সকালে আমি একটা নোটিফিকেশন দেখলাম যাতে বলা হয়েছে দেশে সমস্ত কম্পিউটারে নজরদারী চালানো হবে। আপনি সব রকম তথ্য দিতে বাধ্য। কোনও বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নয়, সাধারণ অবস্থাতেই আপনাকে বাধ্য করা হবে। আর তথ্য না দিতে পারলে আপনাকে সাত বছর জেলে রাখবে। এটা কি কোনও শিল্পপতি, বা কোনও ছাত্র বা সাধারণ মানুষ দিতে চাইবে?
যখন আধার কার্ড ফোনের জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল তখন আমরা লড়াই করেছিলাম। আমাদের বিধায়ক মহুয়া মৈত্র এটা লড়াই করে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমাদের পক্ষে রায় বার করেছেন। আজকে যখন থেকে শুনেছি তখন থেকেই মনে হয়েছে আমাদের কোনও স্বাধীনতা থাকবে না। গোপনীয়তা কিছু নেই।
২০০৯-ও একটা আইন ছিল যাতে লেখা ছিল যে এটা প্রযোজ্য হবে শুধুমাত্র অনিবার্য পরিস্থিতিতে। আজকের নোটিফিকেশনে ১০ সংস্থার নাম আছে যারা আপনার তথ্য চাইতে পারে যে কোনও পরিস্থিতিতে।
এইসব হওয়ার পরে কিছুক্ষণ আগে একটা সংশোধনী এসেছে – যে আগাম পারমিশন নিয়ে এটা করা হবে। আমি জানি না ওরা কী বলতে চাইছে। এই নোটিফিকেশন যেন প্রত্যাহার করা হয়। এটা যতক্ষণ না প্রত্যাহার হবে ততক্ষণ কিন্তু এটা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে প্রতিহিংসামূলকভাবে ব্যবহার হবে।
এটা একটি ছাত্রর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে, একটি বেকার যুবক বা যে কোনও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। সবরকম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এটা ব্যবহার হতে পারে।
আমাদের তাহলে শপথ নেওয়ার কী দরকার? আমাদের গোপন তথ্যও তো ওই সংস্থার হাতে চলে যাবে।
আজকে যদি সবটাই কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে কি একথা বলতে হবে যে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আজকে আমরা পরাধীন হয়ে যাচ্ছি। কেন আমরা পরাধীন হব? স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আমার যদি স্বাধীনতাই কেড়ে নেওয়া হয়, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়, গোপনীয়তা কেড়ে নেওয়া হয়, জীবন কেড়ে নেওয়া হয় লিঞ্চিঙ- এর নামে, এনকাউন্টারের নামে লোক মেরে দেওয়া হয়।
এদেশে তো আবার কিছু কিছু গোরক্ষক বেড়িয়ে গিয়েছে। গরুকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাই বলে তথাকতিত গোরক্ষক মানে মানুষ ভক্ষক? যেখানে যা পারছে সেখানে তার অপব্যবহার হচ্ছে। কত লোক যে এখন দেশে মারা গিয়েছে তা আমি জানি না। কত কৃষক অভাবে আত্মহত্যা করেছে তার দিকে তাকিয়ে দেখেনা কেন? কত যুব ছেলেমেয়েরা নোটবন্দী হওয়ার পরে, জিএসটি হওয়ার পরে, অসংগঠিত প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পুরোটাই কর্মহীন হয়ে গিয়েছে। আমি তো গর্বের সাথে বলতে পারি আমাদের বাংলাতে ৪০ শতাংশ বেকারি কমিয়েছি।
এদেশের সরকার বলে আমরা ২০২২-এ কৃষকদের দ্বিগুণ উপার্জন করব। আমাদের ৪৮ হাজার কোটি টাকা দেনা শোধ করার পরেও আমাদের এখানে তিন গুণ উপার্জন করে দিয়েছি। কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২-এ যা করার কথা বলছে আমাদের সরকার তা করে দিয়েছে।
সারা বাংলায় যা পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে তা তুলনাহীন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ থেকে ২৭ টি তৈরী হয়েছে। মাল্টি-সুপার হাসপাতাল ৪৩ টি তৈরী হয়েছে। এসএনএসইউ তৈরী হয়েছে আরও একশো টি। এইচডিইউ তৈরী হয়েছে, আইসিসিইউ তৈরী হয়েছে, মাদার এ্যান্ড চাইল্ড তৈরী হয়েছে। যখন আমরা ক্ষমতায় আসি তখন ইন্সটিটিউশন ডেলিভারি রেট ছিল ৬৫ শতাংশ এখন আমরা এটাকে ৯৫ শতাংশ করিয়েছি। ৬টা পুলিশ কমিশনারেট তৈরী হয়েছে বাংলায়। প্রায় ১৪৯ টি নতুন পুলিশ স্টেশন তৈরী হয়েছে। কত রাস্তাঘাট তৈরী হয়েছে।
নতুন নতুন কত কিছু আসছে। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নতুন মেট্রো রুট চালু হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আপনাদের পরিবহণেরও কোনও সমস্যা থাকবেনা। এটা আমি যখন রেলমন্ত্রী ছিলাম তখন পরিকল্পনা করে, করে গিয়েছিলাম। ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে প্রকল্প করে গিয়েছিলাম। এগুলো প্ল্যানিং করতে হয়। তিন রকমের প্ল্যানিং হয়: স্বল্পমেয়াদি, মধ্যে মেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি।
ভাবনাটা দিশাহীন কেন হয়ে যাবে? চিন্তাটা নিদ্রাহীন কেন হয়ে যাবে? কথা বলাটা বিবেকহীন কেন হয়ে যাবে? আদর্শটা মুল্যবোধহীন কেন হয়ে যাবে? আমাদের চিন্তায় থাকবে মানুষের কিসে ভালো হয়। ভাবনা যদি এটাই হয় যে একে মারো ওকে মারো, আর এর সাথে ওর বিভেদ লাগিয়ে দাও, এর সাথে ওর দাঙ্গা লাগিয়ে দাও, একে ওকে ঘৃণা করতে শেখো, সে তো মহা মুশকিল!
এমনকি গতকাল নাসিরুদ্দিন শাহ যা বলেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা: ‘আজকে আমার শঙ্কা হচ্ছে যে, আমাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে এই দেশে থাকতে পারবো কিনা’। একই কথা আমার খ্রিষ্টান ভাই-বোনেদের জিজ্ঞাসা করুন, তারাও একই কথা বলবে। ঝাড়খন্ডে তাদের উপর কম অত্যাচার হয়নি। ২৫শে ডিসেম্বর তো ছুটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। এটা আমরা লড়াই করে আদায় করেছি, আমি নিজে চিঠি লিখেছি। আমি ভেবে পাই না কেন এই মানসিকতা থাকবে?
হিন্দু ধর্ম এটা নয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ সার্বজনীন। ঋক বেদ, সাম বেদ, যজুঃ বেদ, অথর্ব বেদ, বেদ-বেদান্ত, অনেকদিন আগে, শত শত বছর আগে, হাজার হাজার বছর ধরে আছে। আর এরা কোথা থেকে চলে এলো, গিরগিটির মতো রঙ পাল্টাচ্ছে। খেতে দেবে না,পড়তে দেবে না,চাকরি দেবে না,জনগণের দিকে তাকাবে না, শুধু বলছে লুটে নাও, লুটেপুটে খেয়ে নাও, আর কেউ যদি প্রতিবাদ করে এজেন্সি আছে গ্রেপ্তার করে নাও। এটাকি দেশের হাল?
বড়দিনের উৎসবের আগে আমরা জোট বেঁধে একথাই বলতে চাই ভারতবর্ষে আবার আগেকার দিনগুলো ফিরে আসুক, গণতন্ত্র ফিরে আসুক, শান্তি ফিরে আসুক, বিশ্বাস ফিরে আসুক, স্বস্তি ফিরে আসুক, একতা ফিরে আসুক, সেক্যুলারিজম ফিরে আসুক।
আসুন ঐক্যের কথা চিন্তা করা যাক, আসুন আমরা ঐক্যের কথা বলি, আসুন আমরা ঐক্য নিয়ে কাজ করি, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকি। ভারতবর্ষের এত ভাষা,এত ধর্ম – সবাই একসাথে থাকি।
আমাদের একটা রক্ষাকবচ হল সংবিধান। সেই সংবিধানটাকে আসুন আমরা সবাই শক্ত করি। সংবিধানটাকে আমরা যেন ছুঁড়ে ফেলে না দিই, সংবিধানটাকে আমরা যেন ছিঁড়ে না ফেলি, সংবিধানটাকে আমরা যেন বিভেদ না করি।
আজকের দিনে যীশু খ্রিষ্টের কাছে প্রাৰ্থনা করব সুমতি দাও, শুভবুদ্ধি দাও, বিবেক দাও, আবেগ দাও, ভালোবাসা দাও, মানবতা দাও, শান্তি দাও। যে রাজনীতিবিদরা মানবতাতে বিশ্বাস করে না, তাদের রাজীনীতি করার অধিকার নেই।
আপনাদের সকলকে বড়দিনের শুভেচ্ছা ও শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
Be the first to comment