রানি রাসমণির মাতৃ আরাধনা

Spread the love

সোমা মুখার্জি : আশ্বিনের পুণ্যলগ্নে হালিশহরে বাংলা ১২০০ সালের ১১ আশ্বিন ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রানি রাসমণি দেবী। ২০১৭ সালের মহাষষ্ঠীর দিন রানি রাসমণির জন্মদিন ছিল। কলকাতার জানবাজারের বাড়িতে গৃহবধূ হয়ে এসেছিলেন রানি রাসমণি দেবী। তাঁর শ্বশুর প্রীতরাম দাস ব্যবসায় আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করার পর জানবাজারে বর্তমানে ১৮ এস এন ব্যানার্জি রোডের জমিদার বাড়িতে শুরু করে মা দুর্গার পুজো। ২২৫ বছর ধরে মা দুর্গার পুজো হয়ে আসছে জানবাজারের বাড়িতে।

বীরভূমের পাকুরের রাজা প্রতিমাশিল্পীদের পাঠিয়েছিলেন দেবী মূর্তি গড়বার জন্য। হিন্দু-মুসলিম পরিবারের সদস্য লালু চিত্রকরেরা এই জানবাজারে জমিদার বাড়ির দেবীমূর্তি নিপুণ হাতে গড়ে তোলেন। রানি রাসমণির বংশধর দীপেনকুমার হাজরার মতে, তাঁদের পরিবার শুধু দেবী শক্তিরই আরাধনা করেন না, সমাজের কন্যাসন্তানদের দেবীরই রূপ হিসেবে দেখেন। রানি রাসমণি দেবী ছিলেন মা দুর্গার আর এক রূপ। মৃত্যুশয্যায় শ্বশুর প্রীতরাম দাস যখন রানি রাসমণিকে ইংরেজ সিপাইদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখেন, তখন প্রীতরামবাবু অনেকটাই মানসিক স্বস্তি লাভ করেন। এবং মনে মনে আশ্বস্ত বোধ করেন যে, রানিমাই হবেন তাঁর উপযুক্ত উত্তরাধিকারিণী।

রানি রাসমণি ও রাজচন্দ্র দাসের চারটি কন্যাসন্তান জন্মায়। উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করে তোলেন তিনি। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। রাজচন্দ্র ছিলেন সেই আন্দোলনে রামমোহন রায়ের প্রধান সহযোগী। আর রানিমা ছিলেন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে রাজচন্দ্রের প্রধান সহযোগী।

১৭৯৪ সালে শ্বশুর প্রীতরাম দাস বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। সেই থেকে আজও তা অব্যাহত আছে। তবে সেদিনের মতো সেই রাজকীয় আড়ম্বর আর নেই। পূর্বপুরুষদের মাড় পদবি থেকে জানবাজারের বাড়িটা মাড়বাড়ি বলে খ্যাত ছিল। আর জানবাজারের দুর্গাপুজো মাড়বাড়ির পুজো নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। এই দুর্গাপুজো উপলক্ষে একবার রানিমার সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সংঘাতের সৃষ্টি হয়। জাঁকজমক আর আভিজাত্যের দিক দিয়ে তখনকার দিনে নাটোরের ‘রানি ভবানী’ আর জানবাজারের ‘রানি রাসমণি’-র পুজোই ছিল সবার উপরে। পুজোর আড়ম্বরের তুলনা করলেও গৃহী সন্ন্যাসী ভক্তিমতী রানি রাসমণির শ্রদ্ধাভক্তি আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কাউকেই বোধহয় তুলনা করা যায় না। স্বয়ং শ্রীশ্রী রামকষ্ণ পরমহংসদেব সখিবেশে এই জানবাজারে মা দুর্গার পুজো করেছিলেন। সমাজের মেয়েদেরও যে মা দুর্গার পুজো করার অধিকার আছে তা সমাজকে শিখিয়ে ছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব। রানিমা ঠাকুরের মাতৃভক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রামকৃষ্ণদেব রানিমার আধ্যাত্মিক চেতনায় মুগ্ধ ছিলেন এবং বলতেন, ‘রানিমা শ্রীশ্রী জগদম্বার অষ্টনায়িকার একজন।’

স্বামী রাজচন্দ্রবাবু বেঁচে থাকতে জানবাজারে একটি সংবাদপত্রের সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছিল। রানিমার আমলেও তা বজায় ছিল। প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ রানিমাকে সংবাদপত্র পড়ে শোনাত। তার মাধ্যমে তিনি দেশ-বিদেশের খবর রাখতেন। তিনি অনেক সভাসমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরকমই একটি ছিল ‘ভারতবর্ষীয় সভা’। সমাজসংস্কার আন্দোলনে জানবাজার চিরদিনই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

দেবীর শক্তি আরাধনা আমরা করি, কিন্তু সমাজের নারীশক্তিকে সম্মানের স্থান দিয়ে গিয়েছিলেন রানি রাসমণি। নিজের জীবনেও সমাজের প্রতিটি স্তরে বিধবা গৃহবধূ রানিমাকে প্রতিবাদ করে নিজের অস্তিত্ব বোঝাতে হয়েছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সমাজের নারীদের কাছে এক বড়ো উদাহরণ জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলার পথে।

জানবাজারের বাড়িতে রানিমার উত্তরসূরিরা ভক্তিভরে মাতৃ আরাধনা করে আসছেন। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী—এই তিনদিনই কুমারী পুজো হয়ে থাকে। লুচি ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে।

মা দুর্গা আমাদের কাছে স্বর্গের দেবী, যাঁকে আরাধনা করতে হয়। আর রানি রাসমণি মানুষ্যরূপী দেবী, যাঁর জীবনী আমাদের সমাজের নারীদের কাছে এক উদাহরণ।

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*