তপন মল্লিক চৌধুরী,
মানুষের নিঃসঙ্গতা কি কেবল বেদনাময় নাকি একাকীত্বেরও আছে তীব্র আবেদন। যদি তা শূন্যতা হয় এবং মানুষ যদি শূন্য হয় তবে সেই জীবন-ছবি ধরা দেয় রোমান পোলানস্কির সেলুলয়েড ফ্রেমে। মানুষকে তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন সব জায়গা-জমিতে নিয়ে চলে যান যেখানে প্রেম-দ্রোহ-শিল্পের জন্ম হয়। মানুষের মনস্তত্ব নিয়েই যেন তিনি অবিরাম খেলে চলেন, সেই খেলাই তার ভালবাসা, খেলাতেই তিনি মত্ত। খেলার গভীরে যাওয়ার চেষ্টায় তিনি লিপ্ত আর তাতেই তাঁর আনন্দ। পোলানস্কির হাত ধরে জন্ম নিয়েছে রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা মনস্তাত্ত্বিক অনবদ্য সব সিনেমা। একদিকে তাঁর সিনেমায় মানুষের নিঃসঙ্গতার তীব্র আবেদন অন্যদিকে সমাজের বাইরে আরেক সমাজ গড়তে চাওয়া- একেবারে নিজস্ব সমাজ, যেখানে প্রেম, দ্রোহ, শিল্প চর্চা সবই ঘটতে থাকে নিয়ম-নীতিহীন সবতস্ফূর্ত ছন্দে।
ফ্রান্সে জন্ম হলেও বাবা-মা ছিলেন পোলিশ। পৈতৃক সূত্রে নাম পেয়েছিলেন রাজমন্ড রোমান লাইব্লিঙ্গ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা কিশোর পোলানস্কির মনের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। যে কারণে পোলানস্কির কাছ থেকে আমরা পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘দি পিয়ানিস্ট’। একজন শিল্পী হিসেবে পোলানস্কি যুদ্ধ আক্রান্ত আরেক শিল্পীর বেঁচে থাকার ছবি তুলে আনেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এক পিয়ানো বাদকের জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই। নানা সময়ে নানা স্থানে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়। অর্ধাহারে অনাহারে তাকে কাটাতে হয় দিনের পর দিন। কিভাবে সেই পিয়ানো বাদক নাৎসীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ান নিজের দেশে। পোলানস্কির নিজের জীবনের সঙ্গে ছবিটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার মা মারা গেলে তিনি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন পোলিশ এক কৃষকের গোলাঘরে। সেখানেই তিনি থাকেন যতদিন পর্যন্ত না যুদ্ধ শেষ হয়। তার বাবা মরতে মরতে বেঁচে যান। তার বাবার সঙ্গে দেখা হয় যুদ্ধ শেষ হবার পর।
পোলানস্কির প্রথম ছবি ‘নাইফ ইন দ্য ওয়াটার’ (১৯৬২) আর হলিউডে তার যাত্রা শুরু হয় ‘রোজমেরি’জ বেইবি’ (১৯৬৮) দিয়ে- এই দুটি ছবিই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারধর্মী। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারধর্মী সিনেমার ক্ষেত্রে আলফ্রেড হিচককের পরই রোমান পোলানস্কির নাম আলোচিত হয়ে থাকে। পোলানস্কি নিজেও তার ছবিতে হিচককের প্রভাব স্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি। নাইফ ইন দ্যা ওয়াটার সিনেমা তাকে বিশ্ব পরিচিতি এনে দেয়। ছবিটি বিদেশী ভাষার সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। এর পর তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি নির্মান করেন যার প্রায় সবকটিই সাইকোলজিক্যাল বিষয় নিয়ে। ১৯৬৫ সালে তিনি বানান তার সাইকোলজিক্যাল হরর মাস্টারপিস “রিপালশন”। একজন মানষিক বিকারগ্রস্থ মানুষের আত্মিক ও মনের ছবি এঁকেছেন পোলানস্কি। ছবিতে ভয়, হিংস্রতা এবং রহস্য এই তিনটি দিক অদ্ভুতভাবে যেন মিশিয়ে ‘রিপালশন’, অনুবাদ করলে দাঁড়ায় বিকর্ষণ।
সিনেমাকে বাস্তবসম্মত করে ফুটিয়ে তুলতে পোলানস্কি নানা ধরণের কৌশলগত আশ্রয় নিয়েছেন এবং সিনেমার জন্য কৌশলের বিষয়টিকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। সিনেমায় যদি ভায়োলেন্স দেখাতে হয় তবে তা যথাযথ ভাবেই দেখাতে হবে। যদি তা বাস্তবসম্মত করে দেখানো না যায় তবে বিষয়টি সিনেমার মধ্যে তুলে ধরা খুব ভুল কারণ তা সিনেমার পক্ষে অনৈতিক ও ক্ষতিকর। দর্শককে যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্তই না করাই গেল তবে আর সিনেমাতে ভায়োলেন্স দেখানোর মানে কি। সেটা তো সিনেমার ক্ষেত্রে অশ্লীলতারই নামান্তর। মনে প্রাণে এ কথা রোমান পোলানস্কি বিশ্বাস করতেন।
পোলানস্কি সিনেমা নির্মানের ক্ষেত্রে পরিচালকের ভূমিকাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সিনেমা অনবদ্য হয়ে ওঠার মূল কারিগর পরিচালক ছাড়া আর কেউই নন। সিনেমা তৈরির নিজস্ব স্টাইল সম্পর্কে পোলানস্কির মত ছিল, তাঁর সিনেমাগুলি প্রতি মুহূর্তের আকাঙ্খার প্রকাশ। সিনেমা তৈরির সময় তিনি কেবলমাত্র তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিকেই কাজে লাগান, তবে তা একটি সুনির্দিষ্ট এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে।
দুর্ভাগ্য আর বিতর্ক যেন পোলানস্কির ব্যক্তিজীবনের নিত্যসঙ্গী। ১৯৬৯ সালে পোলনস্কির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী অভিনেত্রী শ্যারন টেইটকে নির্মমভাবে হত্যা করে দুস্ক্রিতিরা। এরপর ১৯৭৮ সালে পোলানস্কি জড়িয়ে পড়েন নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে। সামান্থা জেইমার নামক ১৩ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে তিনি ৪২ দিনের কারাবরণ করেন। এরপর আমেরিকা ছেড়ে পালিয়ে ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এর পরের জীবন শুধুই পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। তবে সিনেমা বানিয়ে গিয়েছেন নিয়মিত। সেজন্য তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। ব্যক্তিজীবনে নানা কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত পোলানস্কির শিল্পী মন হয়ত প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। তবে ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডে জুরিখ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন। প্রায় ছ’মাস গৃহবন্দি থাকার পর মুক্তি মেলে। এর মধ্যে রাজনৈতিক থ্রিলার ‘দি ঘোস্ট রাইটার’ ছবির জন্য ২০১০ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের ‘রৌপ্য ভল্লুক’ জেতেন পোলানস্কি। তবে গৃহবন্দী থাকায় পুরস্কার গ্রহন করতেও যেতে পারেননি ।
Be the first to comment