চন্দ্রাবলী ব্যানার্জীঃ
খুব ক্লান্ত লাগছে নীরাকে, আজ সাড়ে চারটে তেই বাড়ি ফিরে এলো । ফ্যান এর স্পিডটা বাড়িয়ে, ব্যাগ টা বিছানার একপাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধপাস করে বিছানার উপর বসে পড়লো । কপালের চূর্ণ চুল গুলো ঘামে আটকে আছে কপালে । আঁচল দিয়ে কপালটা মুছে নিয়ে, উঠে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নাতে অনেক্ষন ধরে নিজেকে দেখলো । সত্যি কি সে আগের মতই দেখতে আছে ?
কপালের ঘেটে যাওয়া টিপটা মুছে ফেললো । আবার এসে বিছানায় বসে পড়লো ।
সব কিছু এলো মেলো লাগছে, সেটা শারীরিক না মানসিক উৎপীড়ন বুঝে উঠতে পারেনা । অভয়ের অফিস থেকে আসতে অনেক দেরী , অন্যদিন অভয় আগে ফেরে বাড়ি । নীরাই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে ।
নীরা উঠে গিয়ে জানলার শার্শীর পর্দা গুলো টেনে দিলো । পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়ছে ঘরের ভিতর । চেঞ্জ করতে ইছা করছে না, অন্যদিন অফিস থেকে এসেই স্নান করতে ঢুকে যায়, বাইরের সব ধুলো,নোংরা শরীরে আটকে থাকে ।কিন্তু আজ বিছানার উপর বসে আছে অলস ভাবে । অভয় বলে শুচিবাই নাকি নীরার।
আজ অফিসে কাজের চাপ একটু কম ছিল নীরার, তাই কাজের ফাঁকে ফেসবুক করছিল নীরা, কাজের চাপ কম থাকলে প্রায় করে নীরা । তার খুব ভালো একজন ফেসবুক বন্ধু আছে, হয়তো তার জন্য বা তার সাথে কথা বলার জন্যই করে । খুব মায়া হয় তার ওই বন্ধুর জন্য ।
মানুষটা প্রতিবন্ধী , ট্রেন দুর্ঘটনায় দু’পা হারিয়েছে , হুইল চেয়ারটা তার সারা দুনিয়া, আর আছে এই ফেসবুক ।
মানুষটা কে কোনো দিন দেখেনি নীরা, তার নামও জানেনা , প্রোফাইলে আছে একটা উড়ন্ত চিলের ছবি আর নাম আছে শঙ্খচিল । নীরা কোনোদিন জিজ্ঞাসাও করেনি তার নাম । মনে মনে ভাবে পা নেই বলেই হয়তো ওই মানুষটা উড়ন্ত চিলের ডানায় ভর করে পুরো দুনিয়া ঘুরতে চায় । হায়রে ভাগ্যের বিড়ম্বনা, কত অতৃপ্ত বাসনা তার !!!
নীরাও কোনো ছবি দেয়নি ফেসবুকে শুধু নামটাই দিয়েছে । নীরা সেই মানুষটিকে শঙ্খ বলেই কথা বলে । শঙ্খ অনেক দিন ধরেই একটা ছবি চাইছিল নীরার, দেবো দেবো করেও দেওয়া হয়ে ওঠেনি । ফোনে কোনো ভালো ছবি ছিলোনা, ভর্তি হয়ে আছে অফিসের নানা রকম ডকুমেন্টসে । আজ নীরা ঠোঁটে হাল্কা করে লিপস্টিক দিয়ে খুব সুন্দর করে একটা সেলফি তুলে শঙ্খকে পাঠিয়ে ছিল । অনেকক্ষন পর শঙ্খ একটাই উত্তর দিয়েছিল , তুমি একই রকম আছো তাথৈ, একটুও পাল্টাওনি । শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল নীরা, কে ও, কি করে জানলো এ নাম টা ?
এখন কেউতো এ নামে আর ডাকে না, নীরা তরিঘরি ম্যাসেজ করলো, কে তুমি ? তোমার নাম কি ?
কিছুটা সময় পড়ে পালটা জবাবে নীরা একটা ছবি পেলো, গোলাপী ফ্রক পড়া একটা মেয়ের ছবি ।কিছুটা ঝাপসা, একটা গ্রুপ ছবি থেকে তোলা ছবি সেটা বোঝা যাচ্ছে । একি !!!! এতো নীরারই ছোটো বেলার ছবি । এটা কবে তুলেছিল নীরা ?
এটা কোথায় তোলা ? কে তুলেছিল ?
ব্যস্ত হয়ে নীরা আবার ম্যাসেজ করলো,
তোমার নাম কি ? তোমার ছবি আমাকে পাঠাও, কোনো উত্তর এলো না , নীরা ব্যাকুল হয়ে বার বার ম্যাসেজ করলো, কে তুমি ? তোমার নাম কি ? তোমার ছবি পাঠাও ? যথারীতি কোনো উত্তর এলো না । কিছু মুহুর্ত পরেই ফেসবুক আইডি টা নিস্ক্রিয় হয়ে গেলো । নীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল । একটা প্রশ্ন তার মনে, এ কে ছিলো যে নিজেকে নীরার থেকে আড়াল করলো ? নীরা স্মৃতির অতলে
খুঁজতে লাগলো, কে তুলেছিল তার এই ছবি ? কোথায় তোলা হয়েছিল ?
হঠাৎ নীরার মনে পড়ে যায়, সে তখন ক্লাস টেন এর ছাত্রী । সরস্বতী পূজোর দিন দুই বান্ধবী, নীরা আর অঞ্জনা,
অঞ্জনা দের বাড়ি গিয়েছিল । নীরা খুব ছটফটে ছিল, তাই অঞ্জনার মা আদোর করে তাথৈ বলে ডাকতো । সেটা ওদের বাড়িতে সবার মধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছিল । যৌথ পরিবার ছিল অঞ্জনাদের,খুব ধুমধাম করে সরস্বতী পূজো হত ওদের বাড়ি । সেদিন জোড় করেই নিয়ে গিয়েছিল অঞ্জনা , নীরার খুব লজ্জা করছিল যেতে, পিযুষ ছিলো বলে । অঞ্জনার জ্যেঠতুতো দাদা সে, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে । সেদিন পিযুষ তুলেছিল ছবিটা । এই গোলাপী ফ্রকটা পড়েই সে গিয়েছিল অঞ্জনাদের বাড়ি ।
নীরা একটাই কথা ভাবলো, এতদিন তাহলে কি পিযুষ যত্ন করে তার এই ছবিটা রেখে দিয়েছিল ? কিন্তু কেন ?
অঞ্জনা জানতো, যে নীরা পিযুষকে ভালোভাসে, অঞ্জনা কে বার বার বারণ করা সত্ত্বেও, সে পিযুষ কে বলেছিলো, জানিস, তাথৈ তোকে ভালোবাসে ।
উত্তরে পিযুষ নীরা কে একটা চড় মেরেছিলো । কাঁদতে কাঁদতে নীরা ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলো, সেটাই নীরার শেষ যাওয়া ছিল । আজ বহুদিন পর আবার তাথৈ নামটা শুনলো, কিন্তু একি সেই পিযুষ ? তাহলে নীরার ছবিটা কেন সে রেখে দিয়েছিলো ? ভালোবাসাতো কোনো অন্যায় না তাও সেদিন পিযুষ নীরাকে চড় মেরেছিলো ।
পিযুষতো নীরাকে ভালোবাসেনি, তাহলে কেন রেখেছে এই ছবি ? তবেকি সেদিন ভুল বুঝেছিল নীরা পিযুষকে ?
অতিরিক্ত ভালোবাসার আবেগটাই কি চড়ে রুপান্তরিত হয়েছিল, নাকি অথর্ব হওয়ার পর ভালোবাসার মানুষটাকে আবার মনে পড়েছে পিযুষের ? এর উত্তর জানা নেই নীরার ।।
Be the first to comment