আবুধাবির পুজোর থিম বাংলার পর্যটন

Spread the love

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় : বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের পর্যটনকে তুলে ধরতে চাইছেন বিশ্বের আঙিনায়। আমরা বাঙালিরা ভ্রমণপিপাসু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাতেই যে পর্যটনের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার আছে, তার খবর ক-জন রাখি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।’ আবুধাবির পুজো উদ্যোক্তারা বাংলার মাটি থেকে রয়েছেন অনেক দূরে। কিন্তু অনুধাবন করেছেন, বাংলার পর্যটনের গুরুত্ব। তাই তো এবারে আমাদের থিম ‘পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন’। পেশার তাগিদে আমরা হয়ত রয়েছি জন্মভূমি, মাতৃভূমির থেকে অনেক দূরে। কিন্তু যে মণিমুক্ত বাংলায় ছড়িয়ে আছে, তার সন্ধান পাক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তার টানেই বারবার যেন তারা ফিরে যায় বাংলায়। এটাই আমাদের একান্ত চেষ্টা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন মহালয়া পেরিয়ে গেছে।

মা আসতে আর মাত্র ক-দিন। বলা যায় এসেই গেছেন। জোর উদ্যমে চলছে কর্মযজ্ঞ। ঠাকুর বায়না শেষ—মূর্তি প্রায় সমাপ্ত। এখন শুধু তুলির শেষ টানটুকু বাকি। মৌসুমী, নীতা আর দেবাশিসের তবুও দম ফেলার সময় কোথায়? তুলির এই শেষ ছোঁয়াটুকুতেই তো মা মৃন্ময়ী রূপ থেকে চিন্ময়ী হয়ে উঠবে। তার সঙ্গে ফোকাস, লাইট-এর কথাও তো ভাবতে হবে। ব্যাকড্রপটাও দৃষ্টিনন্দন হওয়া চাই।

না, এ কোনও কুমারটুলি বা পটুয়াপাড়ার দুর্গা প্রতিমার অন্তিম প্রস্তুতির বিবরণ নয়। এ নয় দিল্লি বা মুম্বাই-এর কোনও পুজোর বিবৃতি। আমরা রয়েছি কলকাতা থেকে হাজারো মাইল দূরে এক ঝাঁ চকচকে মরু শহরে। যার নাম আবুধাবি। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির রাজধানী। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্র দুবাই থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে। এখানে প্রতিমা কলকাতা থেকে আসে না। সদস্যদের নিজেদের হাতে তৈরি করা হয় দেবী মূর্তি। উপযুক্ত নামগুলো কোনও প্রখ্যাত পটুয়া বা ভাস্করের নয়, এরা প্রত্যেকেই আবুধাবি বঙ্গীয় পরিষদের সদস্য—দেশের গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে এসে খেটেখাওয়া সাধারণ কর্মনিষ্ঠ বাঙালি পরিবারেরই একজন—কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষিকা, কেউ বা গৃহকত্রী।

আবুধাবির পুজো এবার দশ বছরে পড়ল। পুজো কমিটির কর্মকর্তারা এখন অতি ব্যস্ত। পুজো হবে অন্যবারের মতোই এয়ারপোর্ট রোডে অবস্থিত ফুলল্যান্ড বাঙ্কোয়েট হল-এ। পুজোতে নতুন প্রতিমা তৈরি হয় প্রতি তৃতীয় বছরে। আগে হয়েছে তেল রঙে ক্যানভাসে আঁকা প্রতিমা, গ্লাস পেন্টিং আর ধাতব মূর্তি। এবারের নতুন ঠাকুর হচ্ছে মৃন্ময়ী মূর্তি। হ্যাঁ ঠিক, মাটির ঠাকুর। থার্মোকলের কাঠামোর ওপর মাটি দিয়ে তৈরি পূর্ণাঙ্গ মা দুর্গা— এ এক অসামান্য প্রচেষ্টা। এর সঙ্গে এবারও আছে থিমের ছোঁয়া। বিদেশের মাটিতে (এই মরুদেশে অবশ্য ‘মাটি’-র বদলে ‘বালি’ বলাই ভালো) থিমের পুজো! ভাবা যায়? এ বছরের থিম ‘পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন’। এতে তুলে ধরা হচ্ছে বাংলার দর্শনীয় ও ভ্রমণযোগ্য স্থানের তথ্য। শুধু মা-বাবাদের নয়, বিদেশে বেড়ে ওঠা কিশোর ও শিশু মনে দেশ ভ্রমণের আকর্ষণ আর বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোই এই থিমের প্রধান লক্ষ্য। সদস্যরাই নিজ হাতে তৈরি করেছে মডেল—মন্দারমণি থেকে দার্জিলিং, জলদাপাড়া থেকে সুন্দরবন—যেন সমস্ত বাংলাকে এই চার-পাঁচ দিনের জন্যে মরুশহরে তুলে আনার অক্লান্ত প্রয়াস। যেখানে কয়েক ঘর বাঙালি, সেখানেই দুর্গাপুজোর আয়োজন—এ যেমন অসত্য নয়, তেমনি এটাও ঠিক যে, দুর্গাপুজো কোনও পুতুলখেলা নয়, বিশেষত যখন পুরো পাঁচ-পাঁচটা দিন পঞ্জিকার সমস্ত বিধিনিয়ম মেনে পুজোর ব্যবস্থা। আবুধাবিতে তাই কলকাতা থেকে আসেন পুরোহিতমশাই এবং তন্ত্রধারক। বোধন থেকে শুরু করে সন্ধিপুজো, পুষ্পাঞ্জলি থেকে শুরু করে সন্ধ্যা আরতি—সবকিছুই হয় শাস্ত্রমতে। এদিকে মায়ের পুজোর সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত রোজদিন প্রতিবেলা চলবে পেটপুজো, অন্য বিদেশের পুজোর মতো খালি সপ্তাহান্তে নয়। এ ক-দিন সব বাড়িতে বস্তুত অরন্ধন। পুজো কমিটি ভোগের কুপন দেবে সদস্যদের। কম-সে-কম চারশো লোক ভোগ খাবে প্রতিদিন। খাবারের এলাহি আয়োজন করছে ভোগ কমিটি। লুচি, বেগুন ভাজা থেকে আরম্ভ করে রসগোল্লা, রস-মালাই, পান্তুয়া দিয়ে শেষ। আরে, মাঝেরগুলো তো বলাই হলো না। থাকবে খিচুড়ি, পোলাও, চাওমিন, কড়াইশুঁটির কচুরি, পনীর মাখানি, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, ফিশফ্রাই মায় চিকেন বিরিয়ানি পর্যন্ত। একসঙ্গে প্রবাসী বন্ধুদের সঙ্গে পাত পেড়ে ভোগ খাওয়া, ঢাকের আওয়াজ, ধূপের গন্ধ, সন্ধেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর সারাদিন আড্ডা— এ ক-দিন এক অনাবিল সুখে নিমগ্ন আবুধাবির বাঙালিরা। দুবাই, শারজাহ থেকে তো বটেই, ওমান-কাতার থেকেও দর্শকের আগমন হয় এখানে ঠাকুর দেখতে। সে দিন আর দূর নয় যখন কলকাতা ছেড়ে বাঙালিরা ভিড় করে আবুধাবির দুর্গাপুজো দেখতে আসবে। ছবি সৌজন্য : দেবাশিস মান্না ও পৃথ্বী মুখোপাধ্যায়

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*