তপন মল্লিক চৌধুরী :
ভারতের প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত লাদাখের পূর্বে চীনের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত। জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ স্থানীয় নেতা নির্বাচনের সুযোগ পায় কিন্তু লাদাখবাসী সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মোদী সরকার ২০১৯ সালে যখন সংবিধানের ৩০৭ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের আধা স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয় তখনও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের পাশাপাশি প্রায় সমান মুসলমান ও বৌদ্ধ জনসংখ্যা থাকা লাদাখ একটি অখণ্ড রাজ্য ছিল। মোদী সরকার সেই রাজ্যকে ভেঙে জম্মু ও কাশ্মীর যেখানে আইনসভা রয়েছে এবং লাদাখ যেখানে আইনসভা নেই- দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। লাদাখের আধা স্বায়ত্তশাসন এবং রাজ্যের মর্যাদা বাতিল হওয়ার পর থেকেই সেখানকার নাগরিক সংস্থাগুলি ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল এবং অনশন করে আসছে। লাদাখের সেই বিক্ষোভ-অনশনের সবথেকে পরিচিত মুখ হলেন শিক্ষাবিদ এবং পরিবেষ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুক।
কেন আন্দোলন এবং অনশন? সরকারের ভাষায় লাদাখের মতো বিশেষ পাহাড়ী অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প চালু রয়েছে। কি বা কেমন সেই উন্নয়ন প্রকল্প? প্রথমত লাদাখের পুগা উপত্যকায় ওএনজিসির তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, এনটিপিসির হাইড্রোজেন ইউনিট, সৌরবিদ্যুৎ চালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যার জন্য লাদাখ থেকে হরিয়ানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সিন্ধু নদের উপর আরও সাতটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এর পাশাপাশি প্রায় ১৬০ একর বনভূমি কেটে সাফ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন বসাতে। নদী অরণ্যের বুকে নির্মম আঘাত হেনে এইসব উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সঙ্গে আছেন লাদাখের মানুষ, যারা বোরাক্স, সোনা, গ্রানাইট, চুনাপাথরের মতো লাদাখের প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে নিঃশেষ হতে দিতে চায় না। লাদাখের পরিবেশ ধ্বংস করে পুঁজিবাদের যথেচ্ছ উন্নয়নে তাদের প্রবল আপত্তি। ফলে আদানি এখানে সস্তায় জমি কিনতে পারছে না। আর এতেই বেজায় চটেছে মোদী আর তাঁর সরকার। তার উপর এবার কারগিলের মুসলমানেরাও লাদাখের বৌদ্ধদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। পৃথক রাজ্য ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হওয়ার দাবিতেও তারা সরব। অর্থাৎ দাবি আদায়ে একজোট লাদাখের মুসলিম ও বৌদ্ধরা। হিন্দুত্ববাদী একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে এসব বুঝে শুনে মেনে নেওয়া কী সম্ভব?
যদিও লাদাখের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে লাদাখ অ্যাপেক্স বডি এবং কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স নামের দুটি সংগঠন। কিন্তু আন্দোলনের প্রকৃত মুখ পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকেই লাদাখের সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী করেছে। তাদের মত, সোনমের উসকানিমূলক ভাষণের জন্যই জনতা ক্ষেপে গিয়ে সহিংসতা শুরু করে। উল্লেখ্য, আন্দোলন হিসায় রূপ নেওয়া মাত্র ওয়াংচুক অনশন প্রত্যাহার করেন। কিন্তু সোনম ওয়াংচুককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁকে যোধপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাঁর লাইসেন্স বাতিল করা হয় এবং তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তও শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সবার্থেই তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিলেন ওয়াংচুক? লাদাখে জনপ্রিয় একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ম্যাগসেসে-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুককের মধ্যে রাষ্ট্র সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেয়েছে? যদি তাঁর নেতৃত্বেই লাদাখের মানুষের এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের আন্দোলন আরও গতি পায়, ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত দাবি-দাওয়া সম্বলিত আন্দোলন আরও বেশি গতিময় হয়ে ওঠে, আজকের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লাদাখ সমস্যা কোনোভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক তা নিশ্চয় মোদী বা তাঁর বিজেপি সরকার নিশ্চয় চাইবে না। সেই কারণেই মূল চরিত্রটিকে রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া।
গ্রেফতার করে জনমন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা রাষ্ট্রের একটি কৌশল তো অবশ্যই কিন্তু এতেই কি রাষ্ট্র লাদাখবাসীর অন্তর থেকে তাঁদের গণতান্ত্রিক ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলিকে দাবিয়ে দিতে পারবে? নাকি দীর্ঘ দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ছাই চাপা আগুন চাপা দিয়ে রাখতে পারবে? সময় এর সঠিক উত্তর দেবে সেকথা আমরা সবাই জানি, সেই সঙ্গে এও জানি এই গ্রেফতার সাবধানতামূলক কিন্তু সোনম ওয়াংচুক কেবল একটি নাম নয়। তিনি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি ছাড়াও লাদাখ, সিকিম এবং নেপালের মতো পাহাড়ি অঞ্চলে সৌরশক্তিচালিত বাড়ির নকশা তৈরি করে তার তত্ত্বাবধানেও সহায়তা করেন। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সৌরশক্তিচালিত তাঁবুও তৈরি করেন। তাঁর শিক্ষা রীতি-নীতি নিয়ে বহু দেশ প্রবলভাবে আগ্রহী। আবার সেই তিনি লাদাখ থেকে পাথর এবং প্রাকৃতিক সম্পদ তুলতে নির্বিচারে ডিনামাইট ফাটিয়ে লাদাখের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন পাশাপাশি জনজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চল কেন সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা পাবেনা সেই প্রশ্নও তোলেন। ফলে বিজেপি সরকার তাঁকে অভিযুক্ত করবেই। কিন্তু যেসব রাষ্ট্র তাকে পুরস্কৃত করেছে, সম্মান জানিয়েছে, তারা সবাই যদি তাঁর পক্ষে প্রশ্ন তোলে তাহলে সেই চাপ মোদী বা তাঁর সরকার কি সামাল দিতে পারবে?

Be the first to comment