টোটোর হ্যান্ডেলে সংসারের হাল: স্বামীর পরিত্যাগের পর লড়াইয়ে কৃষ্ণনগরের শিউলি বিশ্বাস

Spread the love

নিজস্ব প্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর:
ভোরের আলো ফুটলেই কৃষ্ণনগরের রাস্তায় দেখা মেলে এক দৃঢ়চেতা নারীর—শিউলি বিশ্বাসের। হাতে টোটোর হ্যান্ডেল, কোলে ছোট সন্তান, কাঁধে গোটা সংসারের দায়িত্ব। বয়স মাত্র ৪১, কিন্তু জীবনযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তিনি বহু আগেই প্রৌঢ় হয়েছেন। সাত বছর ধরে কৃষ্ণনগরের রাস্তায় টোটো চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন শিউলি। শুধু জীবিকা নয়, এই লড়াই তাঁর আত্মসম্মানেরও প্রতীক।

নদীয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগরের উত্তর কালীনগর এলাকাতেই বাড়ি শিউলির। কয়েক বছর আগেও জীবন ছিল শান্ত, স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে ছোট সংসার। কিন্তু হঠাৎ একদিন স্বামী সংসার ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে গেলে ভেঙে পড়ে সবকিছু। সাময়িকভাবে দিশেহারা হলেও থেমে যাননি শিউলি। সংসারের হাল ধরতে নানা কাজ খুঁজেছেন—কেউ বলেছেন বাড়ি পরিষ্কার করতে, কেউ বলেছেন রান্নার কাজ নিতে। কিন্তু টাকার অঙ্ক মিলেনি বাস্তব চাহিদার সঙ্গে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন টোটো চালানোর।

প্রশিক্ষণ নিয়ে রাস্তায় নামেন, আর শুরু হয় এক অন্যরকম সংগ্রাম। শুরুতে কত বাঁকা কথা, কটূ মন্তব্য শুনতে হয়েছে—সব মুখ বুজে সহ্য করেছেন। “প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগত,” হাসতে হাসতে বললেন শিউলি বিশ্বাস, “অনেকে হাসত, খারাপ কথা বলত। কিন্তু আমার কাছে সংসার চালানোই তখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল। মেয়েকে পড়াতে হবে, ছেলেকে খাওয়াতে হবে—এই দুটো ভাবলেই সব ভয় কেটে যেত।”

এখন কৃষ্ণনগরের রাস্তায় শিউলিকে চেনেন না এমন মানুষ কম। অফিসযাত্রী থেকে স্কুলপড়ুয়া—সবাই চেনেন এই হাসিখুশি চালককে। প্রতিদিন ভোরে ছোট ছেলেকে কোলে বসিয়ে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কাউকে অফিসে নামিয়ে দেন, কেউ বা বাজারে যান তাঁর টোটোয়। দুপুরে একটু ফাঁক পেলেই ছেলেকে খাওয়ান, মেয়ের জন্য রান্না করেন, তারপর আবার কাজে ফেরেন।

লকডাউনের সময় আরও একবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন শিউলি। টোটোচালনা বন্ধ, আয়ের পথ শূন্য। কিন্তু বসে থাকেননি। করোনাকালে কৃষ্ণনগরের বহু আক্রান্ত পরিবারের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, খাবার, ওষুধ পৌঁছে দিয়েছেন নিজের টোটোয় করেই। সেই সময়েও কোলে ছিল ছোট সন্তান। “ভয় পেয়েছি, কিন্তু থামিনি,” বললেন তিনি।

আজ কৃষ্ণনগরের পুরুষপ্রধান রাস্তায় শিউলি বিশ্বাস এক প্রতীক—আত্মনির্ভরতা, সাহস আর সংগ্রামের প্রতীক। অন্যান্য টোটোচালকরাও বলেন, “ও সত্যি লড়াকু মানুষ। হাল ছাড়ে না।”

শিউলির গল্প শুধুমাত্র এক নারীর নয়—এ গল্প সেই সব মানুষের, যারা প্রতিকূলতার মধ্যেও মাথা উঁচু করে বাঁচার শক্তি খুঁজে পান। কৃষ্ণনগরের রাস্তায় প্রতিদিন ঘুরে বেড়ায় এক টোটো, যার চাকার শব্দে শোনা যায় এক নারীর জেদি জীবনের সুর।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*