তপন মল্লিক চৌধুরী :
দুনিয়াজুড়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। কেউ বলছেন, মানবিক উদ্যোগকে অবৈধভাবে ব্যাহত করার উদাহরণ। কেউ বলছেন, অবরোধ মানে যে কেবল রাজনীতি নয়, বরং মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন বিশ্বকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কারও মত, ফ্লোটিলা এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে মানবাধিকার ও মানবতার পক্ষে আওয়াজ উঠছে। সমগ্র প্রচেষ্টাটিকে বলা যায় মানুষের সক্রিয়তা আর প্রচেষ্টা মিলে গড়ে ওঠা এক বিশাল মানবিক প্রতিবাদ। সহানুভূতির শক্তি মানে যুদ্ধ নয় বরং সহায়তাই পারে জীবন বাঁচাতে। কিন্তু এত কথার পরেও বিষয়টি কী অধিকাংশ মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট? প্রশ্ন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ব্যাপারটা কী, কেনই বা এমন নাম?
খুব সংক্ষেপে এবং সহজ কথায় ফিলিস্তিনের সমুদ্রপথে ইসরাইলি অবরোধ ভাঙতে এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য যতগুলি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। উল্লেখ্য, প্রায় দু’বছর ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কেবল তাই নয়, ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এই ছোট্ট ভূখণ্ডের উপরেও ইসরাইল সর্বাত্মক অবরোধ নামিয়েছে। এর ফলে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গাজায় কেবল তীব্র খাদ্য সংকট নয় দুর্ভিক্ষও দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, জুলাই মাসে ‘হানদালা’ নামে একটি ত্রাণসামগ্রী ভরতি জাহাজ ইতালি থেকে গাজায় রওনা হওয়ার পর আটকে দেওয়া হয়। তারপর ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এএসি), গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা (জিএমটিজি), মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা এবং সুমুদ নুসান্তারা নামে চারটি সংগঠনের নেতৃত্বে গঠিত হয় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সুমুদ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ অবিচল সহনশীলতা, ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামী জীবনদর্শনের প্রতীক জিএসএফ মূলত ৪০টিরও বেশি জাহাজ ও নৌকার একটি নৌবহর যেখানে ৪৪টির বেশি দেশের প্রায় ৫০০ জন কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যোগ দিয়েছিলেন। যেমন সুইডেনের তরুণ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলা ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য এমা ফোরো।
জাহাজগুলিতে রয়েছে মূলত খাদ্য, ওষুধ, জল ও অন্যান্য জরুরি ত্রাণসামগ্রী। ফ্লোটিলার আয়োজকরা শান্তিপূর্ণ ও মানবিক উদ্যোগে গত মাসের শুরুর দিকে স্পেনের বার্সেলোনা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে (ইতালি ও তিউনিশিয়া বন্দর থেকে আরও কিছু জাহাজ যোগ দেয়) গাজায় জরুরি সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও ইসরাইল শুরু থেকেই এই উদ্যোগকে প্ররোচনামূলক ও নিরাপত্তার আশঙ্কা অভিহিত করে যেকোনো মূল্যে এই নৌবহরকে বারবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে এমনকি ড্রোন হামলাও চালায়। সেই সব বাঁধা পেরিয়েও প্রায় এক মাস পর ফ্লোটিলার কয়েকটি জাহাজ ১ অক্টোবর গাজার কাছাকাছি পৌঁছালে ইসরাইলি নৌবাহিনী জাহাজগুলিতে হামলা চালায় এবং ৪০টিরও বেশি জাহাজ আটক করে। রেহাই পায়না গ্রেটা থুনবার্গসহ স্বেচ্ছাসেবক যাত্রীরাও। ত্রাণ ভরতি জাহাজে হামলার প্রতিবাদে ইতালি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, তুরস্ক, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, মালয়েশিয়া ছাড়াও বহু দেশ প্রতিবাদ জানাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষত হল যুদ্ধ। যুদ্ধের কর্মকাণ্ডেই সৃষ্টি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় আর তার ছাইগাদায় চাপা পড়ে মানুষের আর্তনাদ, শিশুর ভবিষ্যৎ এবং সভ্যতার বিবেক। যে কারণে ফ্লোটিলার উপর ইসরায়েলি হামলায় মানবাধিকার ও মানবতার পক্ষে আওয়াজ উঠছে। যা কেবল গাজার জন্য নয়, সিরিয়া, ইউক্রেন, সুদান যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা যুদ্ধ বা হামলাকে পরাস্ত করে মানবতার জয় আনতে পারবে, আটক নৌকাগুলি মানুষের চেতনায় আশার আলো জ্বালতে পারবে? ফ্লোটিলা তো কেবল গাজার ২২ লাখ অবরুদ্ধ মানুষের কাছে জীবনদায়ী সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ত্রাণ অভিযান নয়, ইজরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে মানবতার চ্যালেঞ্জ। সেটিও আরেকরকম যুদ্ধ তবে অবশ্যই মানবতার। সেই যুদ্ধ এই সত্যকে মুখোমুখি দাঁড় করায়, একদিকে আমেরিকার অনুপ্রাণিত ইজরায়েল সামরিক শক্তি, আর অন্যদিকে হামলার বিরুদ্ধে কোটি মানুষের ক্ষুব্ধ বিবেক। গাজার মানুষ কী ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার হয়েছে তা দুনিয়া দেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘ ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের গণহত্যা দমন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্লোটিলা অভিযান চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো আন্তর্জাতিকভাবে মানবিক ত্রাণ দেওয়ার অধিকারে ইজরায়েল কিভাবে হামলা চালালো। এরপরও কী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির নীরবতায় নেতানেয়াহু বিশ্ব জনমতকে তাচ্ছিল্য করবে নাকি দুনিয়ার জনকণ্ঠ নীরবতা ভেঙে মানবতার পক্ষে এক বিস্ফোরক পদক্ষেপ করবে? কারণ শুধু নিন্দা জানানোটাই যথেষ্ট নয়, গাজার ১৮ বছরের অবরোধ অবিলম্বে শর্তহীনভাবে প্রত্যাহার করতে হবে, সেখানে গণহত্যা বন্ধ করতে হবে, প্যালেস্টাইনের দখল করা ভুমি ছাড়তে হবে।

Be the first to comment