হিন্দু মুসলমান মিলে লক্ষ্মী আরাধনা

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী :
“এখনও পূর্ববঙ্গের এক শ্রেণীর মুসলমানেরা লক্ষ্মীর পাঁচালী গাহিয়া জীবিকা অর্জন করিয়া থাকে। ‘প্রাতঃকালে ছড়া দেয় রে সাঁঝ হৈলে বাতি। লক্ষ্মী বলে সেই ঘরে আমার বসতি।’ ‘সতী নারীর পতি যেন পর্ব্বতের চূড়া। অসতীর পতি যেমন ভাঙ্গা নায়ের গুঢ়া।’ এই সকল গান অনেকেই মুসলমান ফকিরের মুখে শুনিয়া থাকিবেন। এই ছড়াগুলিতে অনেক স্থানে খুব প্রাচীন ভাষার নিদর্শন আছে। ইহা কখনই সম্ভবপর নহে যে মুসলমান ধর্ম্ম পরিগ্রহের পর এই সকল ফকিরেরা লক্ষ্মীর পাঁচালী শিখিয়াছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম্মাবলম্বী থাকার সময় যাঁহারা এই পাঁচালী গাইয়া জীবিকা অর্জন করিত, তাহাদেরই বংশধরগণ সেই বৃত্তি এখনও অব্যাহত রাখিয়াছে।’ প্রায় চুরাশি বছর আগে প্রকাশিত দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইটির এই কথাগুলি পড়ে কারও মনে হতেই পারে যে সেই পরম্পরা আর কতদিন বজায় ছিল। কিন্তু এমন ভাবনা ভাবা খুব ভুল হবে। কেননা দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশের চুয়াল্লিশ বছর পর ডক্টর ওয়াকিল আহমেদের লেখা ‘বাংলার লোক-সংস্কৃতি’ বইটিতেও তিনি লিখছেন, ওইসব ফকিরের, যাঁরা লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে ভিক্ষা করেন। তারপরও পেরিয়ে গিয়েছে অনেকগুলি শীত, বসন্ত, শরৎ ও হেমন্ত, প্রত্যন্ত বাংলার কোথাও কি সেই মুসলমান ফকিরেরা লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন? কোথাও কি সেই লক্ষ্মীর পাঁচালি এখনও টিকে আছে? যুগে যুগে কালে কালের বিবর্তনে মুসলমান ফকিরেরাও লক্ষ্মীর পাঁচালিকে ত্যাগ করেছেন? না পুরোটাই মুছে যায়নি কারণ কিছুকাল আগেও বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলে খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল লক্ষ্মীর এই পাঁচালির- “কৃষ্ণবর্ণ কেশ আর সত্য কথা কয়। / তার গৃহে মোর সদা মন রয়।। / সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যা দেয় শুচি বস্ত্র হৈয়া। / সেই নারী গৃহে আমি থাকি যে বসিয়া।। / প্রতি গুরুবারে যেবা মোরে পূজা করে। / তার গৃহ নাহি ছাড়ি তিলেকের তরে।।” এটির রচনাকার জনৈক মুসলমান ফকির।
বৈচিত্রে ভরা বাংলায় এই যে ঐক্যের সুর কিংবা হিন্দু ও মুসলমান ভিন্ন দুই ধর্মের মধ্যে এই যে অদ্ভুত মিলন তারও কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণ আছে। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে একদিন হঠাৎ গ্রামবাংলার মুসলমান সমাজের একাংশ লক্ষ্মীকে আপন করে নেয়। তাহলে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে জনা যাচ্ছে একসময় বাংলার অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায় ছিলেন হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি। ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরেও তাঁরা পুরনো আচার বা অভ্যাসগুলিকে ছাড়তে পারেননি। এর ফলে ধর্ম বদল হলেও, অনেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লক্ষ্মীকে তাঁদের সঙ্গেই রেখে দেন। ঠিক যেভাবে হিন্দু বিবাহের অনেক আচার গ্রামীণ মুসলমান সমাজে দেখা যায়, একই ভাবে বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীও কিছুটা রদবদলের পর অনায়াসে মুসলমানের ঘরে আশ্রয় পেয়ে যায়। ওই রদবদলের মধ্যে দিয়েই সম্পদের দেবী লক্ষ্মী মুসলমান ধর্মাবলম্বিদের কাছে হয়ে যান ‘লক্ষ্মীবিবি’। ঠিক একইভাবে হিন্দুদের সত্যনারায়ণ মুসলমান গৃহস্থের পুজো পেয়ে থাকেন সত্যপীর রূপে। অন্যদিকে হিন্দুদের বনদেবী মুসলমানদের কাছে হয়ে যান বনবিবি। কোথাও আবার এই ফারাকটুকুও থাকেও না। হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সত্যপীরের সিন্নি খেয়ে থাকেন, বনবিবির থানে ঘোড়া বেঁধে থাকেন। এই মিলন বা ঐক্যের সুরে এগিয়ে চলা বাংলার গ্রাম সমাজের কথা একদিন জানতে পারে শহরভিত্তিক সমাজ। জেনে ফেলে গ্রামবাংলার হিন্দুর ঘরের লক্ষ্মীদেবী মুসলমানদের কাছে ঠাঁই পেয়েছেন ‘লক্ষ্মীবিবি-র পরিচয়ে, যেখানে পাঁচালি পড়া হচ্ছে, ব্রত পালন করা হচ্ছে।
ধর্মের রং ভুলে গিয়ে কেবল লক্ষ্মীবিবি কিংবা সত্যপীর অথবা ব্রত পালন, পাঁচালি পড়া নয়, উৎসবেও গ্রাম বাংলার মানুষ ধর্মকে সরিয়ে রেখে এক হয়ে ওঠেন। যদিও মানুষে মানুষে ভেদ আগের থেকে অনেক বেড়েছে, ধর্ম অনুযায়ী রাজনীতি ভাগ হয়েছে, এতে নিজেদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে, ধর্মের কারণে দাঙ্গা খুন বেড়েই চলেছে, তবু ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য শেষ হয়ে যায়নি কোথাও কোথাও কিছু মানুষ উৎসবে সেই ঐতিহ্যকে বাচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। ধর্ম ভুলে এক হওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন পূর্ব বর্ধমানের আউশ গ্রামের গুসকরা ২ অঞ্চলের শিবদা গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মাথায় ফেজ টুপি পরে লক্ষ্মীপুজো করেন, ভেদাভেদ ভুলে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এটি আজ সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ বা জনমজুরির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাই সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা তাদের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। হয়তো কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দুর্গাপুজোর আগে নতুন জামাকাপড় কেনা সম্ভব হতো না। গ্রামে দুর্গাপুজোর তেমন ধূমও ছিলনা তাই ধুমধাম করে সম্পদের দেবীর পুজো করেন গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। সর্বজনীন লক্ষী পুজোও হয় বেশ কয়েকটি। পুজো ঘিরে তিন-চারদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়, বসে মেলা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*